কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ছয় মাসের উপবৃত্তি ও কিড অ্যালাউন্স (পোশাক ক্রয়) বাবদ অভিভাবকদের নগদ হিসাব থেকে প্রায় অর্ধকোটি টাকা গায়েব হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। উপজেলার ১৫১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে প্রতিটি বিদ্যালয়ের কমপক্ষে ২০ জন শিক্ষার্থীর অভিভাবক টাকা উত্তোলন করতে পারেননি বলে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা জানিয়েছেন।
অভিভাবকদের নগদ হিসাবে টাকা আসার এক সপ্তাহের মধ্যে হিসাব শূন্য হয়ে যায়। শুধুমাত্র উপজেলার আজিয়ারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থীর অভিভাবক তাদের নগদ হিসারের টাকা উত্তোলনের আগেই তাদের টাকা উধাও হয়ে যায় বলে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিশ্চিত করেছেন।
এ হিসেবে উপজেলার ১৫১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে প্রতিটির গড়ে ২০ জন শিক্ষার্থী হিসেবে ৩ হাজার ২০ জন শিক্ষার্থীর প্রতিজন ১ হাজার ৯০০ টাকা হারে ৫৭ লাখ ৩৮ হাজার টাকা হ্যাকাররা উত্তোলন করে নিয়ে গেছেন। এনিয়ে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে।
প্রধান শিক্ষকরা গত মাসের মাসিক সমন্বয় সভায় উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারদের বিষয়টি জানালেও এর কোনো জবাব এখনও পাননি বলে শিক্ষকরা অভিযোগ করেন।
জানা যায়, সারাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ২০০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের মধ্যে অর্ধেক শিক্ষার্থীর অভিভাবক তাদের ছেলে-মেয়েদের উপবৃত্তি এবং কিড অ্যালাউন্সের টাকা তুলতে পারেননি বলে অভিযোগ রয়েছে।
সূত্রে জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর নগদ সফটওয়্যারের মাধ্যমে ২০২১ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ মাসের প্রতি শিক্ষার্থী বাবদ উপবৃত্তি এবং কিড অ্যালাউন্স বাবদ মোট ১ হাজার ৯০০ টাকা গত ২৬ জুন শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের নগদ হিসাবে আসে। কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতিটি বিদ্যালয়ের কমপক্ষে ২০ জন শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা স্থানীয় নগদ এজেন্ট থেকে টাকা না তোলায় নগদ হিসাব থেকে উপবৃত্তির টাকা উধাও হয়ে নগদ হিসাব শূন্য হয়ে যায়। অভিভাবকরা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের কাছে নিয়মিত দ্বারস্থ হয়েও টাকা উদ্ধারে কোনো সমাধান খুঁজে পাচ্ছেন না।
শিক্ষকরা আরও জানান, শিক্ষার্থীদের টাকা নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে নগদের ডিলার, মাঠপর্যায়ের এসআর এবং এজেন্টরা জড়িত রয়েছে। নগদের লোকজন ভুয়া এজেন্ট তৈরি করেন। তারা টাকা উত্তোলন করে নিয়ে যাওয়ার পর ওই এজেন্টের নম্বর আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অভিভাবকদের নগদ হিসাবে টাকা থাকবে। তাদের ইচ্ছেমতো তারা টাকা তুলবে। কিন্তু টাকা তোলার আগেই টাকা নিয়ে যাবে। এর কি কোনো প্রতিকার নেই?
শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের মোবাইল নম্বরের মাধ্যমে নগদ হিসাব খোলা হয়। এতে করে নগদ কর্তৃপক্ষের কাছে মোবাইল নম্বর থাকায় তারা পিন কোড দিয়ে অভিভাবকদের নগদ হিসাব থেকে সহজে টাকা তুলতে পারেন। অথবা হ্যাকররা কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করে টাকা তুলে নিয়ে যায়। কিন্তু অভিভাবকদের জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে নগদ হিসাব খুললে হ্যাকররা এভাবে গণহারে টাকা তুলতে পারতেন না। অভিভাবকদের মোবাইল নম্বর দিয়ে নগদ হিসাব খোলায় হ্যাকাররা সহজে এ টাকা তুলে নিয়ে গেছেন।
আবার অনেক শিক্ষক অভিযোগ করে বলেন, “অনেক অভিভাবক পিন নম্বর মনে না রাখার কারণে এলাকার নগদ হিসাবের এজেন্টের শরণাপন্ন হলে এজেন্টের লোকজন কৌশলে টাকা তুলে নেয়। আবার কোনো কোনো অভিভাবক টাকা তুলতে দেরি করায় হ্যাকাররা টাকা উত্তোলন করে তাদের নগদ হিসাব শূন্য করে ফেলেন।”
এ বিষয়ে কুমিল্লা জেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন মজুমদার বলেন, “আমরা বিষয়টি প্রধান শিক্ষকদের মাসিক সমন্বয় সভায় উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারদের জানিয়েছি। কিন্তু এখনও কোনো প্রতিকার পাচ্ছি না। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জানাচ্ছি, যেসব শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের নগদ হিসাবের টাকা হ্যাকাররা তুলে নেওয়ায় ব্যালেন্স শূন্য দেখাচ্ছে। তাদের নতুন করে চাহিদা দেওয়ার পর নগদ হিসাবে আবারও যেন টাকা পাঠানো হয়।”
সর্বশেষ, উপজেলার বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা তাদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের কতজন শিক্ষার্থী উপবৃত্তি ও কিড অ্যালাউন্সের টাকা পাননি তার তালিকা উপজেলা শিক্ষা অফিসারের কাছে দাখিল করেছেন। পরে এ তালিকা স্থানীয় লাকসাম নগদ অফিসের টেরিটরি অফিসারের নিকট জমা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে নগদের লাকসাম অফিসের টেরিটরি অফিসার আশিকুর রহমান অমিত বলেন, “আমরা এ বিষয়ে অভিযোগ পাচ্ছি। অভিযোগ পেয়ে হেড অফিসে পাঠানোর পর যাচাই-বাছাই করে অনেকের টাকা ফেরত দেওয়া হচ্ছে।”
অভিভাবকদের নগদ হিসাব হ্যাক করে টাকা উত্তোলনের সঙ্গে নগদের ডিলার, এসআর এবং এজেন্টদের জড়িত থাকার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, “কিছু ক্ষেত্রে এজেন্টরা জড়িত রয়েছে। আমরা তাদের মোবাইল সিম কার্ড বন্ধ করে দিচ্ছি। যেসব নগদ হিসাবের টাকা হ্যাক হয়েছে, এগুলোর তালিকা আমাদের কাছে দেওয়া হলে আমরা যাচাই-বাছাই করে তাদের টাকা ফেরত দেব।”
নাঙ্গলকোট উপজেলা শিক্ষা অফিসার মিনহাজ উদ্দিন বলেন, “বিষয়টি আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। যেসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা উপবৃত্তি এবং কিড অ্যালাউন্সের টাকা পায়নি। এ তালিকা আমার কাছে আছে। কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে উপজেলার কতজন শিক্ষার্থী উপবৃত্তি ও কিড অ্যালাউন্সের টাকা পায়নি সে তালিকা আমার কাছে নেই।”