উজানের ঢলে দুর্ভোগে লক্ষাধিক মানুষ


সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৭, ২০২১, ০১:১৭ পিএম
উজানের ঢলে দুর্ভোগে লক্ষাধিক মানুষ

মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে উজানের ঢলে সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি ১০ দিন ধরে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন পানিবন্দি পাঁচ উপজেলার প্রায় ৩৪টি ইউনিয়নের ১ লাখের বেশি মানুষ। বন্যার পানিতে জেলায় সাড়ে ৩০০ কিলোমিটার পাকা রাস্তা তলিয়ে গেছে।

পানিবন্দি অধিকাংশ মানুষ পরিবার-পরিজন ও গবাদিপশু নিয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, আশ্রয়কেন্দ্র, উঁচু রাস্তা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধের ওপরে। এসব মানুষের বিশুদ্ধ খাবার পানি, শুকনা খাবারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। টয়লেটের ব্যবস্থা না থাকায় দুর্ভোগে পড়েছেন অধিকাংশ নারী।

অন্যদিকে করোনার কারণে কাজকর্ম তেমন না থাকায় এক বেলা খেয়ে আরেক বেলা না খেয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন বানভাসি মানুষ। দীর্ঘ সময় পানিতে অবস্থান করায় অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন পানিবাহিত রোগে। তলিয়ে গেছে চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের গ্রামীণ কাঁচাপাকা সড়ক, রোপা আমনসহ সবজিক্ষেত।

সেই সঙ্গে গো-চারণ ভূমি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় গো-খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। খামারিরা অধিক মূল্যে খড় কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। পানিবন্দি মানুষের মাঝে সরকারিভাবে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রয়েছে, তবে চাহিদার তুলনায় তা না পাওয়ার অভিযোগ বানভাসি মানুষের।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস জানায়, জেলার ৫টি উপজেলার ৩৪টি ইউনিয়নের চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এদের মধ্যে সদর উপজেলার ৮টি, কাজিপুরের ৯টি, বেলকুচিতে ৬টি, শাহজানপুরে ৪ ও চৌহালীতে ৭টি ইউনিয়নে প্রায় ১ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়েছে পড়েছেন। এরই মধ্যে বন্যার্তদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে ১৩৯টি আশ্রয়কেন্দ্র। তলিয়ে গেছে এসব অঞ্চলের সাড়ে ৭ হাজার ৩২৫ হেক্টর ফসলি জমি, নদীতে বিলীন হয়েছে প্রায় শতাধিক ঘরবাড়ি।

শহর রক্ষা হার্ড পয়েন্টের ৩ নম্বর বাঁধে আশ্রয় নেওয়া সদর উপজেলার কাওয়াকোলা ইউনিয়নের বাসিন্দা মাজেদা বেগম (৫৫) বলেন, “অন্ধ এক ছেলে আর বৃদ্ধ স্বামীকে নিয়ে অসহায় জীবন যাপন করছি। বন্যার পানিতে বাড়িঘর তলিয়ে যাওয়ায় গরু বাছুর নিয়ে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছি। টিন কেনার সামর্থ্য নেই। তাই তাঁবু টানিয়ে মানুষ ও গরু একসঙ্গে থাকছি। এক বেলা খাই, আরেক বেলা না খেয়ে থাকি। কেউ আমাদের খোঁজখবর নেয় না।”

বাঁধে আশ্রয় নেওয়া হালিমা খাতুন, শাহানা খাতুন, আলম বয়াতি, মোমেনা খাতুন, মাহেলা বেগম, বুলু খাতুন, মাজেদা বেগম, আব্দুর রশিদ, জবেদা বেগম ও সাহেব আলী জানান, বন্যায় আমাদের সবকিছু ভেসে গেছে। আমরা অসহায় অবস্থায় বাঁধে এসে আশ্রয় নিয়ে দুঃখ-কষ্টে মানবেতর জীবন যাপন করছি। তাই সরকারের কাছে আমাদের দাবি, এই অসহায় মুহূর্তে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াতে। খাদ্যসহায়তা দিয়ে আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে, তা না হলে আমরা রোগে শোকে ও ক্ষুধায় মারা যাব।

সিরাজগঞ্জ পৌরসভার মেয়র সৈয়দ আব্দুর রউফ মুক্তা বলেন, এখনো সরকারিভাবে কোনো বরাদ্দ পাওয়া যায়নি, বরাদ্দ পেলে বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করা হবে। এছাড়া বাঁধ এলাকায় যেসব সমস্যা আছে তা ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সিরাজগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আবু হানিফ জানান, যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে নিম্নাঞ্চলের ৭ হাজার ৩২৫ হেক্টর জমির ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। অসময়ের বন্যায় ৫টি উপজেলার ৭ হাজার ৩২৫ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসলি ক্ষেত তলিয়ে গেছে। 

সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম জানান, উজানের ঢলে ৫টি উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। তবে নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি ৮ সেন্টিমিটার কমে সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষাবাঁধ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫৯ সেন্টিমিটার ও কাজিপুর মেঘাই ঘাট পয়েন্টেও ৫ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ৬২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে যমুনার পানি। জেলার চৌহালী ও কাজিপুর উপজেলায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে জিও ব্যাগ ভেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা চলছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

সিরাজগঞ্জ এলজিইডির সিনিয়র প্রকৌশলী মো. বদরুজ্জোহা জানান, বন্যায় জেলার প্রায় সাড়ে ৩০০ কিলোমিটার পাকা রাস্তা পানিতে তলিয়ে গেছে, তবে এখন পর্যন্ত রাস্তার ক্ষতির খোজ পাওয়া যায়নি, রাস্তা থেকে পানি নেমে গেলে ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে।

জেলা প্রশাসক ড. ফারুক আহম্মাদ জানান, বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য এরই মধ্যে উপজেলার ইউনিয়ন পর্যায়ে ২০০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ৫ লাখ টাকা বিতরণ কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। এছাড়া ৭২১ মেট্রিক টন চাল ও আড়াই লাখ টাকা মজুত রয়েছে।

জেলা প্রশাসক আরও জানান, বন্যার্তদের জন্য ১৩৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রসহ বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নেওয়া মানুষদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ শুরু হয়েছে। ভেঙে যাওয়া ও ঝুঁকিপূর্ণ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলোতে মেরামতের কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড, দুর্গত ইউনিয়ন পর্যায়ে মেডিকেল টিম কাজ করছে।

Link copied!