গাজীপুরের সফিপুর আনসার অ্যাকাডেমির সামনে ৫ আগস্ট বেলা ২টার দিকে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন পোশাকশ্রমিক মো. আয়াতুল্লাহ (২২)। এ সময় পুলিশের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলছিল আন্দোলনকারীদের। একপর্যায়ে নিখোঁজ হন আয়াতুল্লাহ। বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিয়ে তার সন্ধান পাওয়া যায়নি।
শুক্রবার (১৬ আগস্ট) টেলিভিশনে বেওয়ারিশ লাশের খবর দেখে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে আয়াতুল্লাহর লাশের সন্ধান পেয়েছেন স্বজনেরা।
লাশ বুঝে পেতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়কসহ বেশ কয়েকজন নিহতের পরিবারকে সহায়তা করেছেন। সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে শনিবার (১৭ আগস্ট) বিকেল ৫টার দিকে লাশ বুঝে পান স্বজনেরা। এরপর লাশ নিয়ে রওনা হন গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলার চামরদানী ইউনিয়নের জলুষা গ্রামের উদ্দেশে।
নিহত আয়াতুল্লাহ সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলার চামরদানী ইউনিয়নের জলুষা গ্রামের কৃষক মো. সিরাজুল ইসলামের ছেলে।
পরিবার জানায়, দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে ছোট আয়াতুল্লাহ। গ্রামের একটি মাদ্রাসায় ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন আয়াতুল্লাহ। পরিবারে অভাবের কারণে আর পড়াশোনা করতে পারেননি। তাঁর বড় ভাই সোহাগ মিয়া গাজীপুরের কালিয়াকৈরে একটি পোশাক কারখানায় অপারেটর পদে চাকরি করেন। অভাবের তাড়নায় দেড় মাস আগে বড় ভাইয়ের কাছে গিয়ে আয়াতুল্লাহ আরেকটি পোশাক কারখানায় শ্রমিকের কাজ নেন।
গত ৫ আগস্ট গাজীপুরের সফিপুর আনসার একাডেমির সামনে ফুপাতো ভাই আরিফুল ইসলাম সুলতানের সঙ্গে গিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন আয়াতুল্লাহ। ওই দিন আনসার অ্যাকাডেমির সামনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে শ্রমিকদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল। পরে বিকেল থেকে তার আর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না।
আয়াতুল্লাহর বড় ভাই সোহাগ মিয়া ও স্বজনেরা গাজীপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে খোঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান পাননি। শেষে টিভিতে বেওয়ারিশ লাশের খবর দেখে ১৬ আগস্ট রাতে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে তাঁর লাশের সন্ধান পাওয়া যায়। আয়াতুল্লাহর শরীরজুড়ে অগণিত ছররা গুলি লেগেছে বলে জানান ফুপাতো ভাই আরিফুল ইসলাম সুলতান।
নিহতের বড় ভাই সোহাগ মিয়া জানান, লাশ বাড়িতে এনে গতকাল রাতে জানাজা শেষে দাফন করেছেন। তিনি ভাইয়ের হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়েছেন।
নিহত আয়াতুল্লাহর ফুপাতো ভাই আরিফুল ইসলাম সুলতান বলেন, “ঘটনার দিন আয়াতুল্লাহ আর আমি একত্রে সফিপুর আনসার অ্যাকাডেমির সামনে গিয়ে আন্দোলনে যোগ দিই। পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আনসার অ্যাকাডেমির ভেতরে অবস্থান নিয়ে নির্বিচারে গুলি ছুড়তে থাকে। গুলিতে আশপাশে অসংখ্য মানুষ লুটিয়ে পড়তে দেখেছি। আয়াতুল্লাহ সব সময় আমার পাশেই ছিল, একপর্যায়ে গুলি ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার মধ্যে আমরা আলাদা হয়ে যাই। পরে আর তাকে খুঁজে পাইনি। কল দিয়ে মোবাইল ফোনও বন্ধ পাই। রাতে আশপাশের সব হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে তার সন্ধান পাইনি। এরপর আত্মীয়-স্বজন সবাই মিলে তাকে অনেক হাসপাতালে খুঁজেছি, কোথাও পাইনি। ১৬ তারিখ টিভিতে খবরে দেখলাম, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পরিচয়বিহীন লাশ রয়েছে। সেই সূত্র ধরে রাতে গিয়ে আয়াতুল্লাহর লাশ পাওয়া যায়। তার শরীর ছররা গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গেছে।”
আরিফুল ইসলাম সুলতান আরও বলেন, “ওই দিন গুলিতে আমার সামনেই অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ১০-১৫ জনকে আমিই রিকশায় তুলে হাসপাতালে পাঠিয়েছি। হাসপাতালগুলোতে লাশের সারি জমে ছিল। এ ছাড়া ড্রেনের মধ্যেও অনেকের লাশ পড়ে ছিল। সেদিন আন্দোলনকারীরা গুলিতে লুটিয়ে পড়ছিল, কিন্তু তাতেও অন্যরা পিছু হটছিল না। এতে আরও বেপরোয়া হয়ে গুলি করছিল। এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।”
চামরদানী ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য উজ্জ্বল মিয়া বলেন, “আয়াতুল্লাহ সম্পর্কে আমার আত্মীয়। তাদের পরিবার ও স্বজনদের মধ্যে মাতম চলছে। শত বুঝিয়েও তার মা-বাবার কান্না থামানো যাচ্ছে না। হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচার চাই।”