• ঢাকা
  • সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

যে টমেটো বাজারের জন্য শ্রমিকদের অপেক্ষা


বিজন কুমার
প্রকাশিত: মে ৩, ২০২৪, ০৩:৪১ পিএম
যে টমেটো বাজারের জন্য শ্রমিকদের অপেক্ষা

বাজারজুড়ে টমেটোর স্তূপ। একেকটি স্তুপের চারপাশে কাজ করছেন ১০ থেকে ১২ জন যুবকের দল। মাঝে-মাঝে কাজের হাঁকডাক চলছে। মহাজন দ্রুত কাজ শেষ করার তাগিদ দিয়ে বলছেন, “লে মামা জলদি করদি। মোকাম ধরা লাগব।” শ্রমিকরাও আঞ্চলিক ভাষা ভুলে রসিকতার সুরে বলছেন, “লইতাছি মামা, খারান।”

এই চিত্র উত্তরের জেলা দিনাজপুরের সবচেয়ে বড় টমেটোর বাজারের। প্রতি বছর সদর উপজেলার শেখপুরা ইউনিয়নের গর্ভেশ্বরী নদীর তীরবর্তী এলাকায় বসে বাজার। বর্তমানে এই বাজার পার্শ্ববর্তী মোস্তান বাজার পর্যন্ত গড়িয়েছে।

এই বাজারের জন্য স্থানীয় হোটেল ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে আশপাশের কৃষক, শ্রমিক সকলেই অপেক্ষায় প্রহর গোনেন। এই বাজারে অল্প সময়ের ব্যবধানে ভালো টাকা আয় করা যায়। যা বছরের অন্যান্য সময়গুলোতে এত কম সময়ে সেই পরিমাণ টাকা আয় করা যায় না।

সরেজমিনে বাজার ঘুরে গেছে, টমেটো বেচাকেনা বেশ জোর দমে শুরু হয়েছে সকাল থেকেই। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত টমেটো ভ্যানে করে বাঁশের খাঁচায় ভরে নিয়ে এসেছেন বাজারটিতে। অপরদিকে এসব টমেটো কিনতে জেলার বাইরে থেকে বাজারটিতে এসেছেন শতাধিক পাইকারি ব্যবসায়ীরা। 

ব্যবসায়ীরা কৃষকদের খাঁচা ভর্তি টমেটো দেখছেন আর পছন্দ হলেই দর কষাকষি করে কিনছেন টমেটো। এরপর হাটের ইজারা নেওয়া স্থানে স্তূপ করে রাখছেন টমেটোগুলো।

এছাড়া হোটেলগুলোতে দেখা গেছে, বাজারের আসা কৃষক, পাইকারি ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের জন্য নিজের হোটেলে বিভিন্ন ধরনের খাবারের পসরা সাজিয়েছেন। যেমন-ভাত, মাছ, মাংস, পরোটা, রুটি, মিষ্টি, ছোলা, মুরি ইত্যাদি।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারটি মূলত শুরু হয় মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে আর চলে জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এই দেড় মাসের জন্য অনেকেই অপেক্ষা করেন। স্থানীয় ছাড়াও পার্শ্ববর্তী উপজেলা থেকেও শ্রমিকরা আসেন এই বাজারে কাজ করতে। বাজারের স্থানীয় হোটেল ব্যবসায়ী ছাড়াও অনেকেই শুধু এই দেড় মাসের জন্যও হোটেল দিয়ে থাকেন।

এই বাজারে মূলত শুরু হয় ভোর থেকে চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। এখানে দুই শ্রেণির শ্রমিক রয়েছেন। এক শ্রেণি কাজ করেন টমেটো প্লাস্টিকের ক্যারেটে সাজাতে। তাদের কাজ ভোর ৫টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত। আর আরেক শ্রেণি শ্রমিকরা আছেন, যারা টমেটোর ক্যারেট ট্রাকে বোঝাই করেন। তাদের দুপুর ১টা থেকে সন্ধ্যা প্রায় ৬টা পর্যন্ত।

ভোরে শ্রমিকরা দৈনিক ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা মজুরির পাশাপাশি অতিরিক্ত ১০০ টাকা পেয়ে থাকেন সকালের খাওয়ার বাবদ। আর ট্রাকে টমেটোর ক্যারেট বোঝাই করা শ্রমিকরা প্রতি দিন একটি ক্যারেট বোঝাইয়ের জন্য খরচ বাদ দিয়ে পান ৩ টাকা। টমেটোবোঝাই শ্রমিকরা একেকজন প্রতিদিন গড়ে ২০০ ক্যারেট টমেটো ট্রাকে বোঝাই করতে পারেন। অন্যদিকে, হোটেল ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, টমেটোর বেচাকেনা শুরু হলে তাদের হোটেলে প্রতিদিন বেচাকেনা হয় প্রায় ৩০ হাজার টাকারও বেশি।  

হিসাব বলছে, যদি মার্কেট দেড় মাস অর্থাৎ ৪৫ দিন হয়। তবে ভোরে আসা শ্রমিকরা মৌসুমে দৈনিক ৫০০ টাকা হিসাবে আয় করেন প্রায় ২২ টাকারও বেশি। আর ক্যারেটবোঝাই শ্রমিকরা আয় করেন প্রায় ৪৫ হাজার টাকা।  

উৎপল নামের এক শ্রমিক বলেন, “এই বাজারটির জন্য শুধু আমি না অনেকেই অপেক্ষা করেন। আমি টমেটোর ক্যারেট ট্রাকে লোড (বোঝাই) করি, ৬০০ টাকা আয় হয়। বছরের অন্যান্য সময় রাজমিস্ত্রির কাজ করি। ওই কাজে দেখা যায়, সকাল ১০ টায় কাজ শুরু করে শেষ করতে করতে সন্ধ্যা ৭টায়। মজুরি সামান্য বেশি ৭০০ টাকা। আর এই বাজারের অর্ধেক বেলা সময় দিলেই বছরের অন্যান্য সময়ের সারাদিনের কাজের টাকা পাওয়া যায়। তাহলে অপেক্ষা তো এই বাজারের জন্য করবো।”

জীবন চৌধুরী নামের আরেক শ্রমিক বলেন, “আমি স্বর্ণের কাজ করি। বিয়ে মৌসুমে স্বর্ণে কাজ বেশি হয়। যেমন শীতের সময়। এখন তেমন স্বর্ণের কাজ নেই। স্বর্ণে ইনকাম কাজের ওপর। যেহেতু এই সময়টাতে স্বর্ণের কাজে তেমন আয় হয় না, তাই প্রতি বছর টমেটোর বাজারের জন্য অপেক্ষা করি। এই বাজার শেষ হলে লিচুর কাজে যাব।”

হোটেল ব্যবসায়ী আব্দুল মোতালেব বলেন, “সারা বছর দোকান করি। টমেটো বাজার শুরু হলেই আয় বাড়ে। বাজার চলাকালীন সময় দৈনিক ১৫ হাজার টাকা ব্যবসা হয়। আর অন্যান্য সময় ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। আবার ভাতের হোটেলে আরও বেশি হয়, তারা ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি বেচাবিক্রি করতে পারে। তাদের অন্যান্য সময় বেচাবিক্রি হয় সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা। আমার দোকানে পুরি, ছোলা, তেলে ভাজা খাবার বিক্রি হয়। যেহেতু বাজার চলাকালীন আয় বেশি, তাই সবাই টমেটোর বাজারের জন্য অপেক্ষা করে।”

টমেটোর বাজার স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বলেন, “এই বাজারে আশেপাশের উপজেলাগুলো থেকে টমেটো আসে। এখানে স্বল্প সময়ে বেশি আয় করতে পারেন শ্রমিকরা। ফলে দেখা যায় এই বাজারের জন্য স্থানীয়রা অধীর আগ্রহে বসে থাকেন, কখন আসবে এই বাজার।”

Link copied!