‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি, চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘নারী’ কবিতার এ কথাগুলো এখন সর্বাংশে সত্যি হয়ে উঠছে সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায়।
একসময় পুরুষের শ্রম-ঘামে গড়ে ওঠা হাওরের কৃষি এখন নতুন সঞ্জীবনী লাভ করছে নারীর হাতের ছোয়ায়।
হাওরে-হাওরে এখন এ অঞ্চলের নারীদের কোমল হাতের ছোয়া আর ঘাম ঝড়ানো পরিশ্রমে দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছড়াচ্ছে কৃষির আবাদ।
একটা সময় হাওরের অবলা, ঘরকুনো ও অসহায় বিশেষণধারী নারীরাই এখন পুরুষের সঙ্গে সমানতালে কাজ করে বদলে দিচ্ছেন হাওরের কৃষি; সেইসঙ্গে দেশকে। সংসার আর সন্তান পালনকারী নারীদের হাতেই গড়ে উঠছে নতুন হাওর।
সারা বছর হাওরের অধিকাংশ নারীরা ঘরমুখী থাকলেও বৈশাখের সময়ের চিত্র উল্টো। ধান শুকানোর কাজ, চিটা ছাড়ানো, গোলায় তোলা, খড় শুকানোসহ অনেক ভারী কাজ করছেন কৃষক পরিবারের নারীরা।
এলাকাবাসী জানান, বৈশাখী মৌসুমে ধান কাটার সময় হাওরের চাষি পরিবারের নারী-পুরুষ সবাইকে মাঠে ব্যস্ত থাকতে হয়। পুরুষরা হাওরের ধান কাটার কাজ করেন। নারীরা সেই ধান মাড়াই, খড় সংগ্রহ, ধান শুকানোর জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করেন। কখনো রাতেও তাদের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। কৃষক পরিবারের পাশাপাশি দরিদ্র ও শ্রমজীবী পরিবারের নারীরাও শ্রমিক হিসেবে হাওরে কাজ করে থাকেন।
নিজেদের খলায় ধান শুকানোর কাজ করছেন জামেলা বেগম। তিনি জানান, পরিবারের একমাত্র কৃষিই সংসার চলার হাতিয়ার। তাই সংসারের অন্য কাজের মতোই কৃষি কাজ তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আর এর মাধ্যমে সংসারে কিছুটা আর্থিক উন্নতি হয় তার জন্যই খুব বেশি একটা সমস্যা হয় না। শুধুমাত্র বাচ্চা-কাচ্চাদের দিকে ঠিকভাবে খেয়াল রাখা কষ্ট হয়ে যায়।
তপ্ত রোদে মাঠে ধান শুকানোর কাজ করছেন দীপ্তি রাণী দাস। হাওরে ৭ খানি জমি চাষ করেছেন দীপ্তির রাণীর স্বামী। পরিবারের পুরুষ সদস্য ধান কেটে খলায় তুলে দিয়ে গেছেন। প্রচণ্ড তাপদাহের মাঝে ধান শুকানোর পর এই ধান প্রক্রিয়াজাত করে গোলায় তুলেন দীপ্তি ও তার দুই মেয়ে।
দীপ্তি রাণী দাস বলেন, “পুরুষরা ধান কেটে খলায় এনে রেখেছে। পরে মেশিন দিয়ে মাড়াই করা হয়েছে। এখন খলায় ধান শুকাই, ওড়াই, খড় শুকাই। এর পাশাপাশি গৃহস্থালি কাজও সামলাতে হয় আমাদের।”
তাহিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ হাসান উদ দোলা জানান, শহরাঞ্চলের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বা অন্য ফ্যাক্টরি থাকলেও হাওরাঞ্চলে তা নেই। যার কারণে হাওরের নারীরা কৃষি কাজ করে টাকা আয় করেন।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, “হাওরে কাজ করা প্রায় তিন লাখ নারী কৃষক পরিবারের সদস্য কিংবা স্বজন। তারা কোনো পারিশ্রমিক ছাড়া কাজ করছেন। তবে পারিশ্রমিক নিয়ে দরিদ্র পরিবারের কিছু নারী কাজ করেন। এবার হাওরে বাম্পার ফলন হয়েছে। আশা করছি আগামী মাসের প্রথম সাপ্তাহে হাওরের সম্পূর্ণ ধান কাটা শেষ হবে।”