দিনাজপুর জেলাকে বলা হয় লিচুর রাজ্য। একদিকে ফলের গুণগত মান, অপরদিকে উৎপাদনের পরিমাণ আর স্বাদ। এসব কারণে এই জেলায় উৎপাদিত লিচুর সমাদর বাংলাদেশ জুড়েই। সাধারণত মে মাসের ২০ তারিখে পর লিচু বাজারে আমদানি হয়। কিন্তু এবারের চিত্র একটু ভিন্ন। এ বছর লিচু বাজারে এসেছে নির্ধারিত সময়ের ১০ থেকে ১১ দিন আগেই।
দশ দিন আগেই কেন বাজারে লিচু?
দিনাজপুর জেলা বর্তমানে তাপদাহের কবলে পড়েছে। সকালের পর থেকেই ধীরে ধীরে প্রখর হওয়া রোদ, পর্যাপ্ত বৃষ্টির অভাব। ফলে গত বছরের তুলনায় দশ দিন আগেই বাজারে আমদানি হয়েছে লিচু। অর্থাৎ আবহাওয়াকেই দুষছেন, বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে চাষি ও ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়াও হরমোনের প্রভাবকেও দুষছেন বিশেষজ্ঞরা। আর ব্যবসায়ীরা বলছেন, অধিক লাভ কিংবা স্বল্প পরিমাণের গাছ থাকার ফলেও লিচু আসছে বাজারে।
বাগানী ওয়াজেদ আলী বলেন, বর্তমানে আবহাওয়া খুবই খারাপ। বৃষ্টির তো দেখা নেই। রোদ যে হারে পড়ে সারাদিনে। তাতে করে দেখা যাচ্ছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর লিচু অনেক আগেই পাকতে শুরু করছে। কিন্তু বৃষ্টির অভাবে লিচুর দানা অনেক ছোট।
লিচু ব্যবসায়ী আকবর বলেন, বাজারে লিচু উঠছে। কিন্তু এসব লিচু পাকছে কম। কোনো কৃষকের হয়তো দুই চারটা গাছ আছে। কিংবা কারও বাড়ি থেকে গাছ দূরে। রং ধরছে তাই হয়তো ভাবছে লিচু পাকছে। আবার কেউ অগ্রিম লাভের আশায়ও নিয়ে আসেন।
দিনাজপুর সরকারি কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করা মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, প্রতিটি উদ্ভিদের বিশেষ কিছু হরমোন রয়েছে। যা ফলকে পরিপক্বতা দিতে সহায়তা করে। যেমন: ইথিলিন। বর্তমানে আবহাওয়ার কারণে লিচু গাছ অধিক পরিমাণে ইথিলিন উৎপাদন করছে। ফলে লিচুর দানা বড় না হলেও লিচু পেকে যাচ্ছে।
বাজারে লিচুর আমদানি হয় যে সময়
ব্যবসায়ীদের মতে, দিনাজপুরের বাজারে সাধারণত মাদ্রাজি জাতের লিচু মে মাসের ২০ তারিখের পর থেকেই আমদানি হতে শুরু করে। একইভাবে জুনের ১ অথবা ২ তারিখের পর আমদানি হয় বোম্বাই, ৫ অথবা ৭ তারিখের পর বেদানা এবং চায়না থ্রি আমদানি হয় জুলাইয়ের ১০ তারিখে পর। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ বছর আগাম জাতের মাদ্রাজি লিচু বাজারে এসেছে মে মাসের ৯ তারিখে। ব্যবসায়ীদের ধারণা এ বছর শুধু মাদ্রাজি নয়, মে মাসেই অর্থাৎ ২২ থেকে ২৪ তারিখেই বাজারে আমদানি হবে বোম্বাই ও বেদানা জাতের লিচু। আর চায়না থ্রি শুরু হবে জুনের ১ অথবা ৩ তারিখের মধ্যেই।
এই বিষয়ে দিনাজপুর ফল আড়তদার সমবায় সমিতি লিমিটেডের সদস্য ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাজিউর রহমান বিপ্লব বলেন, “প্রতি বছর লিচু বাজারে মে মাসের ২০ তারিখে আসে। দুই-চার দিন হয় আগে আসে অথবা পরে। গত বছর আমরা লিচু বাজারে পেয়েছিলাম মে মাসের ২১ তারিখে। কিন্তু এ বছর লিচু বাজারে এসেছে মে মাসের ৯-১০ তারিখেই। এবার হয়তো বাজারে সময়ের আগেই বোম্বাই ও বেদানা একসাথে আসবে।”
লিচুর বাজার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বাজার দর
বর্তমান বাজারে ১০০ লিচুর দাম ২২০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত। বাগানী থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী স্তরে সকলেই বলছেন, এ বছর উৎপাদন কম হওয়ায় বৃদ্ধি পেতে পারে লিচুর দাম। বাড়বে চাহিদা।
লিচুর দাম উল্লেখ করে দিনাজপুর ফল আড়তদার সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি রস্তম আলী বলেন, বাজারে লিচু প্রতি হাজার হিসাবে। গত বছর মাদ্রাজি জাতের প্রতি ১ হাজার লিচু বিক্রি হয়েছে ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকা দরে। এবার বর্তমান বাজারে চলছে ২ হাজার টাকা। এই লিচু ২৫০০ পর্যন্ত দাম বাড়তে পারে। আর অন্যজাতের লিচু। অর্থাৎ বোম্বাই বিক্রি হয়েছিল ১৬০০ থেকে ১৭০০ টাকা হাজার, এবার হতে পারে ২২০০ থেকে শুরু করে ৩ হাজার পর্যন্ত। বেদানা বিক্রি হয়েছিল ৬ হাজার থেকে ১০ হাজার, এবার ৭ হাজার থেকে শুরু করে বাজার দর হতে পারে ১২ হাজার পর্যন্ত। এ ছাড়াও চায়না থ্রি ও অন্যান্য লিচু বিক্রি হয়েছিল ৭ হাজার থেকে ১০ হাজার, এ বছর বিক্রি হতে পারে ৮ থেকে ১৪ হাজার পর্যন্ত।
রস্তম আলী আরও বলেন, “মৌসুমের সময় প্রতিদিন প্রায় আড়াই কোটি টাকার লিচু বিক্রি হয় এই দিনাজপুরে। এ বছর লিচুর উৎপাদন কম। তাই বাজার দর বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। কৃষকরা এবার লাভবান হবে। আমরা স্বল্প কমিশনে বিক্রি করি। আমদানি কম হলে আমাদের আয় কম হবে। আর বেশি হলে বেশি। এখন দেখা যা ওপর আল্লাহ কী করে। আর বাজারে মোটামুটি চাহিদা ভালই থাকবে আশা করা যায়।”
লিচুর ফলন ও দাম নিয়ে বাগানী সনাতন সরকার বলেন, “লিচুর ফলন কম হয়েছে। তাছাড়া বৃষ্টি না হওয়ায় সেচ খরচ আছে। সার-কীটনাশক খরচ আছে। এখন রোদ বেশি আর ঝড়েও যাচ্ছে লিচু। যদি লিচু ৩ থেকে ৪ টাকা বা ৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি না হয় তবে আমাদের লোকসান।”
জেলা জুড়ে লিচুর উৎপাদন ও ফলন
জেলায় সাধারণত লিচু উৎপাদন ৫ ধরনের জাতের। এরমধ্যে রয়েছে মাদ্রাজি, বোম্বাই, বেদানা, চায়না থ্রি ও কাঁঠালি জাতের। জেলা পরিষদের তথ্য বলছে, সব মিলিয়ে মোট আবাদের প্রায় ৩৯ শতাংশ হয় বোম্বাই জাতের। যা সবচেয়ে বেশি। এরপরেই মাদ্রাজি ৩০ শতাংশ, বেদানা ৫ শতাংশ এবং কাঁঠালি জাতের লিচু উৎপাদন হয় ১ শতাংশ।
দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নূরুজ্জামান বলেন, “চলতি মৌসুমে জেলায় প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমিতে লিচুর উৎপাদন হয়েছে। এ বছর প্রায় ৩০ হাজার মেট্রিকটন লিচু উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। মুকুল কম হওয়ায় ফলন কম। বর্তমানে লিচু কিছুটা ঝরছে। এই বিষয়ে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কৃষকরা এবার লাভবান হবেন বলে আশা করছি।”
বিশেষজ্ঞের মত
কথা হলে সিভিল সার্জন ডা. এএইচএম বোরহান-উল-ইসলাম বলেন, “আমাদের লিচুর ক্ষেত্রে তিন শ্রেণির মানুষদের অবশ্যই সচেতন হতে হবে। প্রথমে কৃষক, দ্বিতীয় বাজারজাতকারী এবং তৃতীয় ক্রেতা বা ভোক্তা। কেননা অনেক কৃষকই আছেন যারা লিচুতে কীটনাশক স্প্রে করেন। এই কীটনাশক প্রয়োগের নির্ধারিত সময়ের আগেই লিচু খেলে মৃত্যুও সম্ভাবনাও থেকে যায়। অনেক সময় আমরা শুনি, ঝড়ের সময় লিচু পড়ছে, তা খেয়ে শিশু মারা গেছে। বাজার পর্যায়ে মনিটরিং ব্যবস্থা থাকটা জরুরি। আসলে লিচুটা কীটনাশক প্রয়োগের কতদিন পর নিয়ে আসা হয়েছে। অপরদিকে ভোক্তা ও ক্রেতাদের সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে। একদিকে যেমন অপরিপক্ব লিচু খাওয়া উচিৎ নয়, অপরদিকে অতিরিক্ত খাওয়ায় ভালো নয়। লিচুতে যে এনজাইম থাকে, শরীরে তা বৃদ্ধি পেলে মানুষ অসুস্থ হয়।”