“একটা মৃত ব্যক্তিকে এভাবে কেটে টুকরো টুকরো করল। আমি যতদিন বেঁচে থাকব জীবনে কোনদিন ভুলতে পারব না এই নৃশংসতার কথা। সামান্য হাত কেটে গেলে আমরা বলি কী ব্যথা! সহ্য করতে পারছি না! মৃত ব্যক্তির শরীরে ব্যথা লাগবে বলে আস্তে আস্তে গোসল করানো হয়। আর কেন ওরা আমার বাবাকে এত আঘাত দিয়ে হত্যা করল? আল্লাহ ওদের বিচার করবে। আমার দীর্ঘশ্বাস বৃথা যেতে পারে না। আমি খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।”
শুক্রবার (২৪ মে) বেলা ১১টার দিকে এভাবেই ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে বাড়ির সামনে বসে কান্নায় বুক ভাসাচ্ছিলেন এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন।
নিখোঁজ বাবাকে খুঁজতে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে ঘুরে ঘুরে এদিন ভোরে কালীগঞ্জের বাসায় ফিরে আসেন মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন, তার মা ইয়াসমিন ফেরদৌস শেফালী ও এমপির পিএস আব্দুর রউফ।
পরে বেলা ১১টার দিকে বাড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে আসেন ডরিন। সেসময় স্বজন ও দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে এক হৃদয় বিদারক অবস্থার সৃষ্টি হয়। বাবা হারা সন্তানের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজন-দলীয় নেতাকর্মীরাও।
কাঁদতে কাঁদতে ডরিন বলেন, “প্রি-প্লানিং করে সাজিয়ে গুছিয়ে আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় যার নাম আসছে তাকে বিদেশ থেকে নিয়ে আসুন। কান টানলে মাথা আসবে। তার ওপরে যদি আর কেউ থেকে থাকে তার নামটাও খতিয়ে দেখুন।”
তিনি বলেন, “আমার বাবা কালীগঞ্জ শহরে দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে রাজনীতি করেছেন। তার রাজনৈতিক অরাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থাকতেই পারে।”
এমপি আনারের নামে স্বর্ণ ব্যবসা, হুন্ডি ব্যবসাসহ যে সব বিষয়ে কথা উঠে আসছে সে সম্পর্কে ডরিন বলেন, “আমার বাবার নামে এখন যেসব অপপ্রচার করা হচ্ছে সেটা সঠিক নয়।”
তিনি সাংবাদিকদের কাছে প্রশ্ন করে বলেন, “আপনারা তো এতদিন ছিলেন, তখন কিছু করেননি কেন? প্রিভিয়াস কথা নিয়ে এসে এখন বিতর্ক সৃষ্টি করছেন কেন?”
ডরিন বলেন, “২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আমার বাবার জনপ্রিয়তা দেখে তাকে আটকানোর জন্য, মেরে ফেলার জন্য বিএনপি তার নামে অসংখ্য মিথ্যা মামলা দেয়। ওই সময় আমার বাবা ষড়যন্ত্রের কারণে ১৪ বছর আমাদের কাছে আসতে পারেননি। আমারা বাবাকে কাছে পাইনি। সেসব মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।”
ডরিন বাবা হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে সরকার ও দুদেশের প্রশাসনের প্রতি আস্থাশীল। তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী আমাকে ফোন করে বলেছেন, ‘তুমি ধৈর্য ধরো। আমি তোমার বাবার মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া এবং হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের জন্য সবকিছুই করছি। দুই দেশের পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে’। আমি প্রধানমন্ত্রীর পদক্ষেপের ওপর খুশি। তিনি আমাকে অভয় দিয়েছেন, ভরসা দিয়েছেন। তিনি আমার জন্য সর্বোচ্চ পর্যায়ে চেষ্টা করে যাচ্ছেন।”
শুক্রবার সকালে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের ছোট মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন বাড়িতে আসার খবর শুনে বাড়ির সামনে আসেন শত শত নেতাকর্মী। প্রিয় নেতার মেয়েকে সান্ত্বনা দেন নেতাকর্মীরা।
হত্যার ঘটনা নিশ্চিত হওয়ার কয়েকদিন পেরিয়ে গেলেও এখনো তার মরদেহের সন্ধান না পাওয়ায় হতাশা বাড়ছে দলীয় নেতাকর্মী ও স্বজনদের মাঝে। মেয়ে ডরিনের পাশাপাশি নেতাকর্মীরাও জানাজার জন্য আনারের মরদেহের একটি অংশও হলে চান।
কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কালীগঞ্জ উপজেলা যুবলীগের সভাপতি শিবলী নোমানী বলেন, “মোটরসাইকেলে করে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ খবর নিতেন। তার মতো এমপি আমরা হয়তো আর পাব না। এমপি হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড আখতারুজ্জামান শাহীনকে গ্রেপ্তার করে দেশে আনা হোক। তার কাছ থেকে আরও অনেক তথ্য পাওয়া যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আমি হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবিসহ এমপির মরদেহ খুঁজে বের করে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।”
উল্লেখ্য, গত ১২ মে কলকাতায় চিকিৎসার জন্য যান ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার। ১৩ মে তাকে কৌশলে কলকাতার নিউটাউন এলাকার একটি আবাসিক ভবনে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় হত্যারকারীদের মধ্যে কয়েজন গ্রেপ্তার হলেও এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীন।