• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
অসুস্থ স্বামী নিয়ে রোজিনার জীবনযুদ্ধ

‘যখন অভাবে ছিলাম সবাই ঠাট্টা করেছে, এখন সম্মান করে’


হাসান সিকদার, টাঙ্গাইল
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৯, ২০২৩, ১০:১০ পিএম
‘যখন অভাবে ছিলাম সবাই ঠাট্টা করেছে, এখন সম্মান করে’
অটোরিকশাচালক রোজিনা বেগম। ছবি : সংবাদ প্রকাশ

টাঙ্গাইল পৌরসভায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চালকদের মধ্যে একমাত্র নারী চালক রোজিনা বেগম। তার বাড়ি জেলার বাসাইল উপজেলার আইসড়া গ্রামে। টাঙ্গাইল পৌর শহরের এক প্রান্ত রাবনা বাইপাস আরেক প্রান্ত বেবিস্ট্যান্ড। এই সড়কে প্রতিদিনই অটোরিকশা চালাতে দেখা যায় রোজিনাকে। গত ৫ বছর ধরে অটোরিকশা চালাচ্ছেন তিনি।

টাঙ্গাইল পৌরসভা কার্যালয় সূত্রে জানা যাায়, টাঙ্গাইল শহরে চলাচলের জন্য ৪ হাজার ২০০ ইজিবাইক ও ৫ হাজার ব্যাটারিচালিত রিকশার অনুমতি (লাইসেন্স) দেওয়া হয়েছে। যানজট এড়াতে ৪ হাজার ২০০ ইজিবাইক জোড় এবং বিজোড় সংখ্যায় ভাগ করা হয়েছে। সকাল থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত এক ভাগ এবং বেলা দুইটা থেকে রাত পর্যন্ত আরেক ভাগের ইজিবাইক চলাচল করার নির্দেশনা দিয়েছে পৌর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু রোজিনাকে দুই শিফটে চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

রোজিনার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তার বাবা একজন তাঁতশ্রমিক। তিন বোন দুই ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় রোজিনা। অভাব অনটনের সংসারে বাবা-মা তাকে এক এতিম যুবকের সঙ্গে বিয়ে দেন। বিয়ের পর তার সংসারে দুই কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। অটোরিকশা চালিয়ে কোনোরকম সংসার চালাতেন স্বামী রফিকুল ইসলাম। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় রফিকুলের এক চোখ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। আরেক চোখ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে সেই চোখের দৃষ্টি শক্তিও কমতে থাকে। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে অটোরিকশা চালানো।

সংসারের উপার্জনক্ষম মানুষটি অচল হয়ে পড়ায় স্বামীর চিকিৎসার খরচ, ঘর ভাড়া, খাওয়ার পাশাপাশি মেয়েদের পড়ালেখার খরচ বন্ধ হয়ে যায়। দিশাহারা হয়ে পড়েন রোজিনা। পরে অন্যের বাড়িতে কাজ শুরু করেন। তাতে সংসার চলছিল না। এরপর এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে কোনোরকম সংসার চালাতে পারলেও মেয়েদের লেখাপড়া ও অন্যান্য খরচ জোগাড় করতে পারছিলেন না। এমন পরিস্থিতিতে রোজিনা নিজে অটোরিকশা চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। স্বামী রফিকুলের সহায়তায় গ্রামের স্কুলের মাঠে অটোরিকশা চালানো শেখেন। পরে গ্রামের সড়কে ৫/৬ দিন অটোরিকশা চালিয়ে  একদিন সরাসরি টাঙ্গাইল শহরে চলে যান। এভাবে ধীরে ধীরে অটোরিকশা চালানো শুরু হয় তার।

রোজিনা বলেন, “অটো চালানোটা আমার জন্য খুব সহজ ছিল না। ৫ ও ১০ বছরের দুই মেয়েকে বাড়িতে রেখে অটোরিকশা নিয়ে সারাদিন রাস্তায় থাকতে হয়। তাদের ভালোভাবে দেখাশোনা করতে পারি না। কী করব অভাবের সংসার। ভাড়া বাড়িতে থাকার খরচ কমাতে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে একটু জমি কিনি। পরে সেখানে সরকার আমাকে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর তুলে দেয়।”

তিনি বলেন, “যখন খুব অভাব-অনটনে দিন কাটাচ্ছিলাম তখন মানুষ আমাদের ঠাট্টা করেছে। যখন জীবনের তাগিদে অটোরিকশা চালাতে শুরু করি তখনো নানা কথা বলেছে। তবে এখন তারাই আমাকে সম্মান করে। নারীরাও কিছু করতে পারে।”

রোজিনা আরও বলেন, আমার দুই মেয়ে। বড় মেয়ে আইসড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং ছোট মেয়ে স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। আমার তো থেমে গেলে চলবে না। মেয়েদের শিক্ষিত করতে হবে। ধারদেনা শোধ করতে হবে। আমি অটোরিকশা চালিয়েই দুই সন্তান মানুষ করতে চাই। আমার পাশে যদি সরকার দাঁড়ায় তাহলে আমি অটোরিকশা চালানো বাদ দিয়ে অন্য কোনো কাজ করব।”

ঘারিন্দা ইউনিয়নের (ইউপি) সদস্য বাবুল সরকার বলেন, রোজিনাকে সরকার থেকে একটি ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। রোজিনা অনেক দিন ধরে অটোরিকশা চালান। আগে গ্রামের কিছু মানুষ নানা কথা বলত, পরে রোজিনার সংকল্প আর দৃঢ়তা দেখে তারা থেমে যায়। এখন আমরা তাকে নিয়ে গর্ব করি।”

টাঙ্গাইলের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (প্রশাসন) দেলোয়ার হোসেন বলেন, “শহরের একমাত্র নারী অটোচালক রোজিনা। কেউ যেন তাকে বিরক্ত করতে না পারে সেদিকে ট্রাফিক পুলিশ সবসময় নজর রাখে। আমাদের ট্রাফিক পুলিশ তাকে সবসময় সহযোগিতা করে।”  

টাঙ্গাইলের সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক শাহ আলম বলেন, “আপনার মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পারলাম। ওই নারী এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে আসেননি। তিনি যদি আমাদের কাছে এসে আবেদন করেন অবশ্যই তাকে আমরা সহযেগিতা করব।”

Link copied!