মিয়ানমারে চলছে গৃহযুদ্ধ। জান্তা সরকারের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন বিদ্রোহী গ্রুপের সংঘর্ষ চরম অবস্থায় পৌঁছেছে। পার্শ্ববর্তী দেশের এই সংঘাতের প্রভাব পড়েছে উখিয়া-টেকনাফেও। ওপাড়ে যুদ্ধের কারণে টেকনাফ স্থল বন্দর দিয়ে পণ্য আনা নেওয়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এতে বেকার হয়ে পড়েছেন অনেক শ্রমিক।
কথা হয় ট্রাকচালক আমির হোসেনের সঙ্গে। সারা দিন ব্যস্ত সময় পার করা মানুষটি এখন অলস সময় কাটাচ্ছেন সীমান্তের ধারে বসে। মাথায় একটিই চিন্তা, কখন শেষ হবে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ।
তার মতো টেকনাফ স্থল বন্দরের ১ হাজারের মতো শ্রমিকের একই প্রশ্ন—কখন ফিরবে আবারও সুদিন। নাফ নদীতে মাছ ধরা ট্রলারগুলোর মাঝি-মাল্লারাও এখন অলস সময় কাটাচ্ছেন।
টেকনাফ স্থলবন্দরে মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যের মংডু শহর ও আকিয়াব বন্দর থেকে প্রতিমাসে আড়াই থেকে তিন শতাধিক কার্গো ট্রলারে করে বিভিন্ন ধরনের (দৈনিক ৮০ থেকে ১৫০ ট্রাক) পণ্য সামগ্রী আনা-নেওয়া হয়। তবে এক মাস ধরে দিনে মাত্র ২ থেকে ৩টি কার্গো ট্রলার আসছে বলে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
টেকনাফ স্থলবন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্ট লিমিটেডের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ব্যবস্থাপক অবসরপ্রাপ্ত মেজর সৈয়দ আনসার মোহাম্মদ কাউসার বলেন, “আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্থবির বলা চলে। এখানকার ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে উদ্বেগে রয়েছেন।”
স্থল বন্দরের শ্রমিকদের নেতা আলী আজগর বলেন, প্রায় এক হাজার শ্রমিক এখন বেকার। স্বাভাবিক সময়ে স্থল বন্দরে দিনে ৬০ থেকে ৯০টির মতো ট্রাক থেকে পণ্য ওঠা-নামা হতো। ওপারে যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে এখন এক সপ্তাহেও একদিনের কাজ হচ্ছে না।
টেকনাফ স্থলবন্দরের আমদানিকারক মোহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানিতে ধস নেমেছে। তিনি বলেন, “আকিয়াব বন্দরে কিনে রাখা বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের শত শত মণ আদা, নারকেল, শুঁটকি, সুপারি ও ছোলা মজুদ রয়েছে। এগুলো না আনতে না পারলে ব্যবসায়ীদের অনেক ক্ষতি হবে।”
টেকনাফ স্থল বন্দরের শুল্ক কর্মকর্তা এ এস এম মোশাররফ হোসেন জানান, বন্দরে পণ্য কমে যাওয়ায় সরকারের রাজস্ব আয়ও কমেছে। আগে যেখানে মাসে ১০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হতো, তা গত কয়েক মাসে ৩০-৪০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।”
সীমান্তে সংঘাত নাফ নদী ব্যবহার করে গভীর সাগরে যাওয়া টেকনাফের ৬ শতাধিক ট্রলারের মালিক ও জেলেদের জীবনযাত্রাও জটিল করে তুলেছে। এই নাফ নদীর দুই পাশে দেই দেশ। নদীর এক পাশে কক্সবাজার, তার ঠিক ওপারেই মংডু। নাফ নদী হয়ে গভীর সাগরে যান ৬ শতাধিক ট্রলারের ১১ হাজারের বেশি জেলে। তারা এখন বেকার।
সাবরাং নয়াপড়া এলাকার ট্রলার মালিক আবদুল গফুর বলেন, “আগে জানলে ট্রলার নাফ নদীতে না এনে পশ্চিমের সাগর মোহনায় রাখতাম। কিন্তু এখন সাগরেও যাওয়া যাচ্ছে না।”
বিপাকে রয়েছেন চিংড়ি চাষিরাও। টেকনাফের উনচিপ্রাং সীমান্তে নাফ নদীর এপারে রমজান আলীর রয়েছে ৬০ একর চিংড়ি ঘের। ১০ ফেব্রুয়ারি গোলাগুলির পর থেকে আতঙ্কে আছেন তিনি।
রমজান বলেন, “নাফ নদীর এপারে ৬০ একর চিংড়ি ঘের বর্গা নিয়ে চাষ করছি। বছরে বর্গা দিতে হয় ৯ লাখ টাকা। আমার ২০ জন কর্মচারী। তারাও আতঙ্কিত, আমরাও আতঙ্কিত। এরকম পরিস্থিতি চলতে থাকলে চরম লোকসান গুনতে হবে।”
টেকনাফের জ্যেষ্ঠ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন জানান, হোয়াইক্যং ও হ্নীলা ইউনিয়নের বেড়িবাঁধের আশপাশে ২ হাজার ৪০০ হেক্টর জায়গাজুড়ে ৪০০ চিংড়ি ঘের রয়েছে। যেখানে ৮ শতাধিক চাষি। মিয়ানমারে সংঘাতের কারণে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।