নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ ঐতিহ্য ও প্রাচীন স্থাপত্য-কীর্তির জন্য বিখ্যাত। ঐতিহাসিক পানাম নগর এখানে অবস্থিত। কিন্তু মেঘনা নদীর গতি পরিবর্তন এবং মানুষ ও প্রকৃতির নানাবিধ কর্মকাণ্ডে এ নগরীর নিদর্শনগুলো ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। সেই সোনারগাঁয়ের গোয়ালদি মসজিদ মধ্যযুগীয় স্থাপত্য ও ঐতিহাসিক নিদর্শন হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে।
পৌরসভার গোয়ালদি গ্রামে স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহর আমলে নির্মিত মসজিদটি পর্যটকদের আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ১৫১৯ সালে মোল্লা হিজাবর আকবর খান এ মসজিদ নির্মাণ করেন। সে অনুযায়ী এটি আলাউদ্দিন হোসেন শাহর (১৪৯৪-১৫১৯) রাজত্বকালে নির্মিত। আলাউদ্দিন হোসেন শাহর আমলে বাংলার শিক্ষা, শিল্প ও সাহিত্য উৎকর্ষ লাভ করেছিল।
সোনারগাঁয়ে হোসেন শাহর রাজত্বকালের যেসব শিলালিপি পাওয়া যায়, তার মধ্যে এ মসজিদ-সংলগ্ন শিলালিপি অন্যতম। ভারতের গৌড়, পান্ডুয়া ও বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানের ইমারতের মতো এ মসজিদের ভেতর ও বাইরের দেয়ালে পাথর এবং ইটের ওপর আরব্য অলংকরণ লক্ষ করা যায়। এক গম্বুজবিশিষ্ট এ মসজিদের চার কোনায় চারটি টাওয়ার রয়েছে। টাওয়ারগুলো সুলতানি রীতিতে তৈরি। মসজিদটির দেয়ালগুলো ১ দশমিক ৬১ মিটার প্রশস্ত। মসজিদে প্রবেশের জন্য পাঁচটি খিলান পথ রয়েছে। প্রধান প্রবেশপথ বরাবর মূল মেহরাবটি অবস্থিত। এটি কালো পাথরের তৈরি। অন্য দুটি মেহরাব ইটের তৈরি। এ মসজিদের টেরাকোটা নকশায় যেসব মোটিফ পাওয়া যায়, সোনারগাঁয়ের সুলতান গিয়াস উদ্দিন শাহর প্রস্তরনির্মিত সমাধিতে তা লক্ষ করা যায়। এ মসজিদের পুরু ইটের পৃষ্ঠভাগ টেরাকোটা অলংকরণ রীতিতে খোদাই করা।
সরেজমিনে দেখা যায়, মসজিদটি অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদের ইতিহাস সংবলিত একটি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে তাতে উল্লেখ করেছে, মোগল আমলে ঢাকায় রাজধানী স্থাপনের আগে সোনারগাঁয়ে বার ভূঁইয়া প্রধান ঈশা খাঁ, মুসা খাঁ ও এর আগের স্বাধীন সুলতানদের রাজধানী ছিল। রাজধানী ও রাজসভার জন্য মনোরম ইমারত ছাড়াও মুসলিম শাসকেরা এখানে মসজিদ, খানকা ও সমাধি নির্মাণ করেন। তার মধ্যে এ মসজিদ অন্যতম।
জানা গেছে, সোনারগাঁয়ের বিভিন্ন পুরাকীর্তি পরিদর্শনে আসা দেশি-বিদেশি পর্যটক এ মসজিদ পরিদর্শন না করে চলে যান, এমনটা কখনো হয় না। সুলতানি আমলের গৌরবোজ্জ্বল মুসলিম ঐতিহ্যের অন্যতম সাক্ষী এ মসজিদ।
সোনারগাঁয়ের স্থানীয় বাসিন্দা সাজিব বলেন, এ মসজিদটির কারণে আমরা এলাকাবাসী গর্ববোধ করি। ঐতিহাসিক এ পুরাকীর্তি দেখতে দেশ-বিদেশের পর্যটকেরা এখানে ভিড় করেন।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. আরিফ বলেন, “মসজিদটি আনুমানিক সাড়ে পাঁচশ বছর আগে তৈরি হয়েছিল। এটি আমাদের গ্রামের জন্য একটি ঐতিহ্য। মসজিদের পশ্চিম-দক্ষিণ পাশের একটি পিলার হেলে পড়ে সামান্য ভেঙে গেছে। এটি যদি সংস্কার করা হয় তাহলে এই ঐতিহ্যটা রক্ষা পাবে। তাছড়া চারপাশে যে বাউন্ডারি দেয়াল রয়েছে সেটির কিছু অংশ ভেঙে গেছে। কর্তৃপক্ষ আশা করছি এটির দিকে সুনজর দেবেন।”
কুমিল্লা থেকে আসা মো. আরমান নামের এক দর্শনার্থী বলেন, “আমি দেশের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখি। মূলত বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে আমার খুবই আগ্রহ। সোনারগাঁয়ের এই পুরনো মসজিদটি দেখতে এসেছি। এটি মুসলিম স্থাপত্যের অন্য নিদর্শন। এটি সরকারে যথাযথ কর্তৃপক্ষ রক্ষা করা দরকার। যাতে দেশের বিভিন্ন মানুষ এসে মসজিদটি দেখতে পারে। মসজিদের চারপাশের কারুকার্যগুলো অনেক সুন্দর, আসলেই দেকে মুগ্ধ হয়েছি। আমি সবাইকে এটি দেখার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। এই মসজিদ সম্পর্কে আগে জানতাম না। সোনারগাঁ এসে জানতে পারলাম, দেখে গেলাম।”