ক্যাপ্টেন নূর মোহাম্মদ বাবুল। যিনি ‘ক্যাপ্টেন বাবুল’ নামেই বৃহত্তর ফরিদপুর তথা বাংলাদেশের মানুষের কাছে অধিক পরিচিত। ‘স্টেট ভার্সেস শেখ মুজিব অ্যান্ড আদারস’ অর্থাৎ ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব এবং অন্যান্য’ মামলার ৫ নম্বর আসামি ছিলেন ক্যাপ্টেন বাবুল। যাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামেই বাংলাদেশের মানুষ জানেন। যে মামলায় শেখ মুজিবকে প্রধান করে ৩৫ জনকে আসামি করা হয়েছিল।
নূর মোহাম্মদ ক্যাপ্টেন বাবুল মুক্তিযুদ্ধকালীন ৯ নম্বর সাব সেক্টরের (বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চল) যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন।
জন্ম ও পরিচয়
নূর মোহাম্মদ ক্যাপ্টেন বাবুল ১৯৩৪ সালের ২ জানুয়ারি মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থানার অন্তর্গত কুমারভুক গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা তমিজউদদীন আকন ছিলেন একজন কাপড় ব্যবসায়ী। মা রাবেয়া খাতুন ছিলেন গৃহিণী। তিনি স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। পরে তার বাবা ব্যবসায়ীক উদ্দেশ্যে ফরিদপুরে এলে তারাও ফরিদপুরে চলে আসেন এবং জেলা শহরের গোয়ালচামট এলাকায় বসবাস করতে থাকেন।
পরে নূর মোহাম্মদ বাবুল শহরের হিতৈষী স্কুলে ভর্তি হয়ে সেখান তিনি ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর ফরিদপুর জেলা স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে দশম শ্রেণিতে পড়াকালীন নৌবাহিনীর নাবিক পদে চাকরি হয় তাঁর। পরে চাকরিতে থাকাকালীন ১৯৫৩ সালে করাচি বোর্ডের অধীনে মেট্রিক পাশ করেন যুদ্ধকালীন এ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার।
নৌবাহিনীতে চাকরি
নৌবাহিনীতে চাকরিকালীন পদোন্নতি পেয়ে নূর মোহাম্মদ বাবুল নাবিক থেকে ‘পিটি অফিসার’ হন। পিটি অফিসার হিসেবে নাবিকদের প্রশিক্ষণ দিতেন তিনি। চাকরির সময়ে তাঁর সাহসিকতার বিষয়টি পুরো নৌবাহিনীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। চাকরির সুবাদে দেশ-বিদেশেও ভ্রমণ করার সুযোগ হয় তাঁর। ১৯৬৯ সালে চাকরি থেকে অবসর নেন এ মুক্তিযোদ্ধা।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের করা একটি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আওয়ামী লীগ নেতা ও পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জন প্রখ্যাত ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করেছিল। ১৯৬৮ সালের প্রথম ভাগে দায়ের করা এই মামলায় অভিযোগ করা হয় যে, শেখ মুজিব ও অন্যান্যরা ভারতের সাথে মিলে পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এই মামলাটির পূর্ণ নাম ছিল ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য মামলা’। এ মামলায় ৫ নম্বর আসামি করা হয় নূর মোহাম্মদ বাবুলকে। তখনকার রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার শাস্তি ছিল আসামিকে গুলি করে হত্যা করা।
সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা
মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে ক্যাপ্টেন বাবুলসহ নৌবাহিনীর একটি টিম মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে গিয়ে পরাধীনতার শিকল ভেঙে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীনতার কথা বলেন। তবে মাওলানা ভাসানী সমর্থন জানালেও তিনি তখন বলেছিলেন, ‘আমার তো বয়স হয়েছে, তাই তোমরা শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করো। সেই পারবে এর নেতৃত্ব দিতে।’ তখন তারা, ভারতে গিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বাসায় থাকা শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন এবং সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে দেশ স্বাধীনতার কথা বুঝিয়ে বলেন। কথা শুনে শেখ মুজিব একাত্মতা প্রকাশ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও যুদ্ধ
শেখ মুজিব রহমানের আদেশে তৎকালীন বৃহত্তর ফরিদপুরের (বর্তমান গোপালগঞ্জ) কাশিয়ানী উপজেলার ভাটিয়াপাড়া, ওড়াকান্দি, রামদিয়া কলেজ, যেতুকান্দি, ওরাকান্দির ঠাকুরবাড়ি এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ হয় নূর মোহাম্মদ বাবুলের নেতৃত্বে গঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের। নতুন মুক্তিযোদ্ধাদের ওড়াকান্দি স্কুল মাঠে প্রশিক্ষণও দিতেন নূর মোহাম্মদ। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে চিরা, মুড়ি, গুড়সহ শুকনো খাবার খেয়ে যুদ্ধ করতেন তাঁরা। কখনো পাঁচ-সাতদিন পরও ভাত খেয়েছেন।
স্বাধীনতা-পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠা
আগামী প্রজন্মকে জাতির এ গৌরবের ইতিহাস জানাতে ও মহান মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শন সংরক্ষণ এবং প্রদর্শনের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার নূর মোহাম্মদ বাবুল যুদ্ধ শেষে নিজ বাড়ি ফরিদপুর শহরের গোয়ালচামট এলাকায় ‘মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগার’ প্রতিষ্ঠা করেন। যেখানে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বিরল ছবি, বইসহ নানা নিদর্শন শোভা পাচ্ছে। তবে, যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে মুক্তিযুদ্ধের এসব নিদর্শনগুলো ধুলাময়লা ও পোকামাকড় নষ্ট করে ফেলছে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ নানা প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন থেকে ৭০-এর অধিক সম্মাননা, ক্রেস্ট এবং নানা পুরস্কার পেলেও এখন পর্যন্ত পাননি রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা কিংবা একুশে পদক।
এ প্রসঙ্গে নূর মোহাম্মদ ক্যাপ্টেন বাবুল বলেন, “পুরস্কারের জন্য এ দেশ স্বাধীন করেনি। তাই আমি কখনো স্বাধীনতা পদকের জন্য আবেদন করেনি। আমার দেশের কাছে পুরস্কার চেয়ে নিতে হবে কেন?”
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁকে ডেকে নিয়েছেন উল্লেখ করে ক্যাপ্টেন বাবুল বলেন, “শেখ মুজিবকে সরাসরি না করে দিয়ে বলেছিলাম, কোনো পুরস্কার পাওয়ার আশায় আমি যুদ্ধ করেনি। আমি কিছু চাই না। আমাদের দেশের মানুষ যাতে ভালো থাকতে পারেন, সুখে থাকতে পারে, সেটাই আমি চেয়েছিলাম।”
এ ব্যাপারে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. কামরুল আহসান তালুকদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “ফরিদপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন বাবুল। মুক্তিযুদ্ধে বিরাট অবদান রয়েছে তাঁর। তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি ছিলেন, কারাবন্দী ছিলেন। একই সাথে তিনি এই ফরিদপুরের মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত কিংবদন্তি। তার একটি পাঠাগার ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর রয়েছে। তাঁর পাঠাগারে মুক্তিযুদ্ধের বিরল কিছু ছবি ও বই রয়েছে। আমরা খুব তাড়াতাড়ি এ জাদুঘর ও পাঠাগারটি পরিদর্শন করব।”