পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির সন্দেহে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থীকে অমানবিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের সভাপতিসহ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।
নির্যাতনের পর তাদের পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তবে, নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে পাবিপ্রবি কর্তৃপক্ষ ও ছাত্রলীগ।
মঙ্গলবার (৪ এপ্রিল) রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আবাসিক হলে এ ঘটনা ঘটে।
এদিকে, ঘটনার পর শিক্ষার্থীদের আহত হওয়ার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, ছাত্রলীগ বা পুলিশ কেউই দায় নিচ্ছে না। ছাত্রলীগ ও পাবিপ্রবি কর্তৃপক্ষের দাবি, তাদেরকে কোনও প্রকার নির্যাতন করা হয়নি। সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় পুলিশের কাছে সোর্পদ করা হয়েছে। ওই সময় তাদের শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন ছিল না। আর পুলিশের দাবি, শিক্ষার্থীদের আহত অবস্থায়ই উদ্ধার করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
নির্যাতিত শিক্ষার্থীরা হলেন লোক প্রশাসন বিভাগের মাস্টার্স শেষ বর্ষের গোলাম রহমান জয় (২৫), ইংরেজি বিভাগের অনার্স চতুর্থ বর্ষের আসাদুল ইসলাম (২৩) এবং ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ট্রিপল ই) বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আজিজুল হক (২৩)।
এদের মধ্যে আসাদুল ইসলাম ও আজিজুল হককে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে থানা হেফাজতে নেওয়া হয়েছে, আর গোলাম রহমানের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাকে পুলিশী পাহারায় হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীরা জানান, তারাবির নামাজ শেষে তারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন। এ সময় ছাত্রলীগ কর্মীরা ১০-১২ জন তাদের কাছে এসে দাঁড়ি, পাঞ্জাবী দেখে শিবির কিনা জানতে চান। পরে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা তাদের ধরে হলে নিয়ে যায়। এ সময় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ফরিদুল ইসলাম বাবুর নেতৃত্বে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের তিনটি আলাদা কক্ষে নিয়ে স্ট্যাম্প, রড, হকিস্টিক, প্লাসসহ দেশীয় অস্ত্র দিয়ে নির্যাতন করে। হাতুড়ি, জিআই পাইপ, তালা দিয়েও মারধর করে তারা। নির্যাতনের এক পর্যায়ে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়ে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি কাগজে লিখিত নিয়ে পুলিশের হাতে সোপর্দ করে।
আসাদুল ইসলাম ও আজিজুল হক বলেন, “ছাত্রলীগের সভাপতি ফরিদুল ইসলাম বাবুর নেতৃত্বে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দাঁড়ি-টুপি থাকায় তারা আমাদের বিভিন্ন হুমকি দিচ্ছিলেন। পরে আমাদের হলে নিয়ে গিয়ে তিন রুমে তিনজনকে নির্যাতন করা হয়। আমরা শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত নই, আমরা সাধারণ শিক্ষার্থী। আমাদের অপরাধ আমরা নামাজ-রোজা করি, দাঁড়ি-টুপি আছে। এজন্য জোর করেই আমাদের শিবির কর্মী বানিয়েছে।”
ছেলে আটকের খবর শুনে বুধবার (৫ এপ্রিল) দুপুরে সদর থানায় আসেন আসাদুল ইসলামের বাবা আবুল কালাম। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আমি গরীব মানুষ। অটোরিকশা চালিয়ে ছেলেকে লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছি। আমার ছেলে কখনও শিবির করেনি। মিথ্যা অভিযোগ দেওয়া হচ্ছে আমার ছেলের বিরুদ্ধে।”
এ বিষয়ে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. কামাল হোসেন বলেন, “বেশ কয়েকজন শিবিরকর্মী ক্যাম্পাসে গোপন বৈঠক করছিল। এ সময় তাদের আটক করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। খবর পেয়ে আমরা তাদের উদ্ধার করে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছি। তাদের কাছে বিভিন্ন রকম শিবিরের নোটবুক ছিল। তাদের কোনো ধরণের মারধর করা হয়নি। সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় তাদেরকে পুলিশে সোর্পদ করা হয়েছে। নির্যাতনের বিষয়ে আমরা কিছু জানি না।”
একই সূর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা নাজমুল হোসেনের। তিনি বলেন, “প্রক্টর ড. কামাল হোসেনের মাধ্যমে খবর পেয়ে আমি ক্যাম্পাসে এসেছিলাম। পরে ওই শিক্ষার্থীদের আটক অবস্থায় দেখি। তাদের কাছে থেকে শিবিরের রিপোর্ট বই, ব্যক্তিগত ডাইরি এবং কিছু মোবাইল ও সিম উদ্ধার করা হয়। পুলিশের কাছে সোপর্দের আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদেরকে কোনও নির্যাতন করা হয়নি।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রভোস্ট ড. ওমর ফারুক বলেন, “প্রক্টর ও ছাত্র উপদেষ্টার ফোন পেয়ে হলে এসে ওই শিক্ষার্থীদেরকে দেখতে পাই। তারা আমার হলের শিক্ষার্থী নয়, ক্যাম্পাসের বাইরে থাকে। তারা নিজেরা শিবির বলে স্বীকারোক্তি দিলে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। এখানে ছাত্রলীগ মারধর করেছে কি না জানি না।”
এ বিষয়ে পাবনার পুলিশ সুপার আকবর আলী মুনসী বলেন, “খবর পেয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আহত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করেছি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আর নির্যাতিতরা যদি অভিযোগ দেয়, তাহলে তদন্ত করে অবশ্যই আইনি ব্যবস্থ গ্রহণ করা হবে।”
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে তাদের মারধর করা হয়নি, সম্পূর্ন সুস্থ্য অবস্থায় তাদের পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে। তাহলে ওই তিন শিক্ষার্থী কীভাবে আহত হলেন জানতে চাইলে পুলিশ সুপার বলেন, “এটা সাধারণ একটা ব্যাপার। আমরা তাদের আহত অবস্থায় পেয়েছি। তারা কীভাবে আহত হয়েছে, কারা মারধর করেছে, সেটি ওই শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসা করলেই বেরিয়ে আসবে।”