নওগাঁর আত্রাই, ছোট যমুনা, তুলসীগঙ্গা, নাগর, শিব, ফকিরনী ও পুনর্ভবা নদী একসময় ছিল স্থানীয় মানুষের জীবিকার উৎস। এই সাত নদী ঘিরেই এখানকার কৃষি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। মৎস্যজীবীদেরও জীবনেও ছিল প্রাণচাঞ্চল্য। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন আর ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে শুকিয়ে গেছে নওগাঁর বুক চিরে বয়ে যাওয়া এ নদীগুলো। সেই সঙ্গে চলছে দখল আর দূষণের প্রতিযোগিতা। শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই পানিশূন্য হয়ে পড়ায় বোরো সেচ নিয়ে শঙ্কিত এসব নদীতীরের হাজারো কৃষক। বেকার হয়ে পড়েছেন নদীনির্ভর শত শত মৎস্যজীবী।
স্থানীয়রা বলছেন, আগে এসব নদী অনেক প্রমত্তা ছিল। ছিল হাজার হাজার মানুষের জীবিকার উৎস। বর্তমানে বছরে মাত্র তিন থেকে চার মাস পানি থাকে। এরপর ধু-ধু বালুচরে পরিণত হয়। শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই নদীগুলো এখন পানিশূন্য প্রায়।
ভারতে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে উৎপত্তি আত্রাই নদীর। এরপর ভারতের পশ্চিম দিনাজপুর হয়ে নদীটি বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এ নদীটি জেলার ধামইরহাট, পত্নীতলা, মহাদেবপুর, মান্দা, আত্রাই ও রাণীনগর দিয়ে প্রবাহিত। খরা মৌসুম এলেই ভারত অভ্যন্তরে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে নেয়। আবার বর্ষা মৌসুমে বাঁধ কেটে দেয়।
বাঁধ দেওয়া ও পানি প্রত্যাহার করার কারণে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। দিনাজপুর জেলার ইছামতি নদী পার্বতীপুর উপজেলার মোমিনপুর ইউনিয়নে ছোট যমুনা নদী নাম ধারণ করেছে। এই নদীটি জেলার ধামইরহাট, বদলগাছী, সদর, রাণীনগর ও আত্রাই উপজেলাজুড়ে বিস্তৃত। এ নদীটিও মরা খালে পরিণত হয়েছে।
আত্রাই তীরের বাসিন্দা মো.খলিল বিশ্বাস নামের এক প্রবীণ ব্যক্তি বলেন, খুব বেশি আগের কথা নয়, আশির দশকেই এসব নদীর ভরা যৌবন ছিল। আত্রাইয়ের তর্জন-গর্জনে মানুষের বুকে কাঁপন ধরত। নদীতে চলাচল করত পাল তোলা অসংখ্য নৌকা। মাঝিরা নৌকা নিয়ে ছুটে চলতেন আত্রাই, রাণীনগর, মান্দা, মহাদেবপুর, ধামইরহাট, পত্নীতলাসহ অন্যান্য জেলা ও উপজেলার নদীকেন্দ্রিক ব্যবসা কেন্দ্রগুলোতে। এ নদী ঘিরে বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছিল বড় বড় হাটবাজার।
এসব নদীকে অবলম্বন করে অসংখ্য মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে জীবন-জীবিকার পথ খুঁজে পেয়েছিলেন। নব্বইয়ের দশক থেকেই যৌবন হারাতে শুরু করে আত্রাই নদী। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, নদীটির আর যেন হারানোর কিছুই নেই। সরু হয়ে মরা খালে পরিণত হয়েছে। এক শ্রেণির দখলবাজ নদীটির অনেক স্থান দখলে নিয়ে ভরাট করছে। চলছে যত্রতত্র বালু উত্তোলন ও পাড় কেটে মাটি বিক্রির প্রতিযোগিতা।
এতে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে নদীটির অস্তিত্ব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অধিকাংশ নদীর উৎপত্তিই ভারতে। ভারতের অভ্যন্তরে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার, উৎসের অববাহিকায় বৃষ্টিপাত কম হওয়া, পলি জমে তলদেশ ভরাট, ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার ও জলবায়ুর পরিবর্তন এসব নদীর অস্তিত্ব সংকটের প্রধান কারণ।
নওগাঁর এ সাতটি নদী রক্ষার দাবিতে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন নিয়মিত কর্মসূচি পালন করে আসছে। সচেতন মহল বলছেন, জরুরি ভিত্তিতে তলদেশ ড্রেজিং, রাবার ড্রামে পানি সংরক্ষণ ও ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমানোর মাধ্যমে এসব নদী রক্ষা সম্ভব। নওগাঁর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট ডি এম আবদুল বারী বলেন, নদী রক্ষায় যথাযথ উদ্যোগ দরকার।
নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী প্রবীণ কুমার পাল বলেন, ইতোমধ্যে নদী খননের বিষয়ে এমপি মহোদয়দের সঙ্গে কথা বলে চাহিদা পাঠানো হয়েছে। আশা করা যায় শিগগিরই বরাদ্দ পাওয়া যাবে। বরাদ্দ পেলে নদীগুলোর খননকাজ শুরু হবে।