গোড়াই শিল্পাঞ্চলে তীব্র গ্যাস সংকট


টাঙ্গাইল প্রতিনিধি
প্রকাশিত: এপ্রিল ৭, ২০২৩, ১০:০২ এএম
গোড়াই শিল্পাঞ্চলে তীব্র গ্যাস সংকট

তীব্র গ্যাস সংকটে দেশের অন্যতম টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের গোড়াই শিল্পাঞ্চল এলাকার প্রায় অর্ধশত কলকারখানায় উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। গ্যাস সংকটে এ অবস্থায় শিল্প উৎপাদন অর্ধেকের নিচে নেমে গেছে। উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় মিলকারখানায় প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার লোকসান গুনতে হচ্ছে। সময়মত উৎপাদন না হওয়ায় রপ্তানিকারকরা ক্রয়াদেশ বাতিলের আশঙ্কা করছেন।

গোড়াই শিল্পাঞ্চল এলাকায় গ্যাস পাইপলাইনের চাপ সকালে তিন থেকে চার পিএসআইয়ের (প্রেসার পার স্কয়ার ইঞ্চি) নিচে নেমে যায়। এতে দিনের বেলায় বেশিরভাগ কারখানায় গ্যাসের প্রেসার থাকে না। তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল, নিটিং কারখানাগুলোর সক্ষমতা থাকা স্বত্বেও উৎপাদন না থাকায় তারা আর্থিক লোকসানের মুখে পড়েছে। সংকট চরম আকার ধারণ করছে।

গোড়াইয়ের শিল্পকারখানার ব্যবস্থাপকরা জানিয়েছেন, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক সংলগ্ন গোড়াই শিল্পাঞ্চলে ছোট বড় মিলে প্রায় অর্ধশত মিলকারখানা রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে ২০টি সিএনজি স্টেশন। এসব কারখানায় প্রায় ৫০-৬০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। সাধারণত জেনারেটর বা বয়লার চালানোর জন্য এসব পোশাক কারখানাগুলোয় ১৫-১৬ পিএসআই গ্যাস চাপের প্রয়োজন। কিন্তু গ্যাসের চাপ ৪-৫ পিএসআইয়ে নেমে এসেছে। এ চাপে কোনোভাবেই গ্যাসচালিত মেশিন চালানো যাচ্ছে না।

সবচেয়ে খারাপ অবস্থা সকালের দিকে। দুপুরের পর থেকে চাপ কিছুটা বাড়তে থাকে। গ্যাস না থাকায় প্রতিদিন কোটি টাকার পণ্য উৎপাদনে চরম ব্যাঘাত ঘটছে। এতে করে রপ্তানিমুখী বহু শিল্প প্রতিষ্ঠান লোকসানের মুখে পড়েছে। গ্যাস না পেয়ে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ডিজেলের ব্যবহার বাড়ায় কারখানাগুলোয় পণ্যের উৎপাদন খরচও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাতে গ্যাসের চাপ পাওয়া গেলেও সারা দিন কম থাকে। এর ফলে কোনো কোনো কারখানার একটি ইউনিট কোনোমতে চালানো সম্ভব হলেও গ্যাসের পর্যাপ্ত চাপ না থাকায় পুরোপুরি উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। ছোট ও মাঝারি মানের অধিকাংশ কারখানাই গ্যাসের অভাবে বন্ধ রাখতে হচ্ছে। তাঁরা জানান, গ্যাসের এই তীব্র ঘাটতি দ্রুত মেটানো না গেলে অর্থনীতি ও বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় মেশিনারিজের ক্ষমতার মাত্র অর্ধেক ব্যবহার করা হচ্ছে।

গোড়াই হামীম গ্রুপের এক্সপ্লোর গার্মেন্টস লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার কদ্দুসউল আলম বলেন, “এই প্রতিষ্ঠানে প্রায় তিন হাজার শ্রমিক কাজ করে। তৈরি পোশাক বিদেশে রপ্তানি করে শতভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। এতে করে আমরা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছি। কিন্তু  গ্যাসের চাপ স্বল্পতার কারণে কারখানা পুরোপুরি চালু করা যাচ্ছে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে কারখানার উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। প্রতিদিন প্রতিষ্ঠানটি লাখ লাখ টাকা লোকসান গুনছে।”

এ ব্যাপারে নাহিদ কটন মিলস লিমিটেড এবং ডেলসি কটন স্পিনিং মিলস লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) ফারুক হোসেন বলেন, কোভিড-১৯ এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশের তৈরি পোশাকশিল্পের ক্রয়াদেশ এমনিতেই কমে যাচ্ছে। সেখানে যেসব ক্রয়াদেশ আসছে তাও যদি সময়মতো শিপমেন্ট না করা যায় তাহলে তৈরি পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন। গোড়াই শিল্প এলাকায় ১৫০ ফিডার লাইনে গ্যাসের চাপ পাওয়া যাচ্ছে না। এলএনজির দাম বাড়ানো হলেও গ্যাসের পর্যাপ্ত সরবরাহ বাড়েনি। গ্যাসের সংকট থাকায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে প্রতি মাসে তাদের কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।

একই অভিযোগ করেছেন ইমপ্রেস ইনটেক্স, উত্তরা স্পিনিং মিলস, টেকনো স্পিনিং মিলস, কম্পিট কম্পোজিট, সাউথ ইস্ট টেক্সটাইল ও নিউটেক্স গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের কর্মকর্তা এবং পরিচালকরা। হাজার হাজার লোকের জীবিকা নির্বাহ টিকিয়ে রাখতে হলে দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার দাবি জানান তারা।

উত্তরা স্পিনিং মিলসের প্রকল্প পরিচালক বিধান সরকার বলেন, “গ্যাস সংকটের কারণে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে কারখানা গুলো চলছে। এলএনজি আমদানি কম হলেই কারখানার উৎপাদন অর্ধেকের নিচে নেমে আসে। এলএনজি আগে ছিল ১৬ টকা এখন ৩০ টাকা। তারপরও প্রয়োজনমত সরবরাহ করা যাচ্ছে না। যেমন আমদের প্রতি ঘণ্টায় ১৫০০ কিউবেক মিটার গ্যাসের প্রয়োজন। কিন্তু আমি পাচ্ছি ৪০০ থেকে ৫০০ কিউবেক মিটার। যা প্রয়োজনের তুলনায় একবারেই অপ্রতুল। এতে করে উৎপাদন না হওয়ায় কোটি কোটি টাকার লোকসান গুনতে হচ্ছে।”

টাঙ্গাইল তিতাস গ্যাস সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে তিন হাজার দুই শ মিলিয়ন থেকে তিন শ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু উৎপাদন হচ্ছে দুই হাজার চার শ থেকে পাঁচ শ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। ঘাটতি থেকে যাচ্ছে প্রায় আট শ থেকে নয় শ মিলিয়ন ঘনফুট। যা দেশের জেলাগুলোতে সমন্বয় করা হয়। 
 
টাঙ্গাইল তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপক খোরশেদ আলম বলেন, প্রতিদিন তাদের গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে ৪০ মিলিয়ন ঘনফুট। টাঙ্গাইলে তাদের প্রতিদিন প্রয়োজন ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট। তারা পাচ্ছেন ৪০ মিলিয়ন ঘনফুট। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় তাদের হিমশিম খেতে হয়। সকালে সব এক সঙ্গে শিল্পকারখানা সিএনজি স্টেশন ও আবাসিকে এক সঙ্গে কাজ শুরু হওয়ায় সকালে গ্যাসের চাপ কম থাকে। দুপুরের পরই কিছুটা চাপ বৃদ্ধি পায়। গোড়াই এলাকার শিল্পের মালিকদের পক্ষ থেকে গ্যাস না থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের গাজীপুর শাখার ব্যবস্থাপক (অপারেশন) রেদুয়ানুজ্জামান জানান, সরিষাবাড়ির তারাকান্দি যমুনা সার কারখানা, এলেঙ্গা, টাঙ্গাইল, মির্জাপুরের বিভিন্ন শিল্পকারখানা ও চান্দরা পর্যন্ত আমরা গ্যাস পাই ৯৮ মিলিয়ন ঘনফুট। তার মধ্যে নিরবিচ্ছিন্নভাবে অন্তত ৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট যমুনা সার কারখানায় দিতে হচ্ছে। এছাড়াও টাঙ্গাইলের আবাসিক, সিএনজি স্টেশন ও শিল্পকারখানায় মাত্র ৫৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। অন্তত ১৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পেলে চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হতো।

Link copied!