• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

‘জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছেলেকে জমি লিখে দেওয়া’


নীলফামারী প্রতিনিধি
প্রকাশিত: আগস্ট ১, ২০২৩, ১০:০১ পিএম
‘জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছেলেকে জমি লিখে দেওয়া’

“আমার সামান্য একটু জমি ছিল, এক বছর আগে সেই জমিটা ছেলেকে লিখে দিই। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হলো এটাই যে আমি ছেলেকে জমি লিখে দিয়েছি। ছেলেকে জমি লিখে দেওয়ায় মেয়ে কথা বলে না। আর ধীরে ধীরে ছেলেও কথা বলা ও আমাকে দেখাশোনা করা বন্ধ করে দেয়। ছেলে ব্র্যাকে চাকরি করে। এখানে আসার পর এখন পর্যন্ত আমার ছেলে-মেয়েরা কোনো খবর নেয়নি। আর মনে হয় না কখনো তারা আমার খোঁজ নিতে আসবে। আর যদি তারা আসেও আমি যাব না। তারা আমাকে যে কষ্ট দিছে সেটা বর্ণনা করা সম্ভব না।”

এভাবেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন রংপুরের পীরগাছার বড়দরগাহাট পূর্ব ফকিরা গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ারুল মমিন।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পঞ্চাশোর্ধ্ব আনোয়ারুলের সম্প্রতি ঠাঁই হয়েছে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের নিভৃতপল্লিতে গড়ে ওঠা নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রমে। যে স্ত্রী-সন্তানকে সুখে রাখতে নিজের সর্বস্ব দিয়েছেন, তারই যেন আজ আপন বলতে কেউ নেই।

শুধু আনোয়ারুলই নন, তার মতো অনেক অসহায় মা-বাবা বসবাস করছেন এই নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রমে। চোখে-মুখে যাদের বয়সের ভাঁজ, অন্তহীন বেড়াজালে বন্দী তারা। এখন শুধু পরপারের হাতছানির অপেক্ষা। অথচ এই মা-বাবা একসময় তাদের সন্তানদের মানুষ করতে কতই না কষ্ট করেছেন। তারাই আজ সন্তানের কাছে ঝরে পরা শুকনা পাতার মতো।

সন্তানদের ঘরে জায়গা হয়নি এসব মা-বাবার। অভিমান হয় সন্তানদের প্রতি কিন্তু কোনো ক্ষোভ নেই। বুকের মধ্যে হাহাকার, বোঝা নামাবার কোনো জায়গা নাই। কখনো কষ্টের কথা মনে করে ডুকরে কাঁদেন, কখনোবা ভাবেন বেশ আছেন তারা।

সরেজমিনে নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রমে পঞ্চাশোর্ধ্ব আনোয়ারুল মমিন সঙ্গে কথা হয়। তিনি সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “আমি বিএডিসিতে চাকরি করতাম। আমার এক ছেলে তিন মেয়ে। দুই মেয়ে আর ছেলের বিয়ে দিয়েছি, এক মেয়ের বিয়ে হওয়া এখন বাকি আছে। ছেলে-মেয়েদের নিজের সবটুকু দিয়ে লেখাপড়া করাইছি। আমার বাড়ি ছিল ১২ শতক জমিতে। বাড়িটা ছেলের নামে লিখে দেওয়ার পরে ছেলে আর  কথা বলে না, মেয়েরাও কথা বলে না। মেয়ে আছে দিনাজপুরে। আমি কয়েকদিন আগে সেখানে গেছিলাম। আমাকে কোনো খাবার দেয় না, আমার সঙ্গে কেউ কথা বলে না, আমার স্ত্রীও না। আমাকে ভাড়ার টাকাও দেয় নাই। শেষ পর্যন্ত আমি চলে আসছি সৈয়দপুরে বৃদ্ধাশ্রমে। কিন্তু ওখানে তারা শুধু মহিলাদের রাখেন। এরপর তারাই আমাকে সাজুর ভাইয়ের কথা বলেছিলেন। আমার চোখে উনি খুব ভালো লোক। আমাকে জুতা, জামা-কাপড় সবই দিয়েছেন। আমাকে এখান থেকে যাইতে দেননি।”

তিনি আরও বলেন, “দিনাজপুরে মেয়ের বাসায় যে কয়েকদিন ছিলাম আমাকে ভাত দেয় নাই। ছেলে যখন ঢাকা থাকে তখন ছেলের বউ বাড়িতে থাকত, সকালে রান্না করত না, রান্না করত তিনটার সময় ভাত দিতে দিতে পাঁচটা বাজত। তখন ভাত খাইতাম এভাবে নামাজ রোজা হয় না। এভাবে পেটে ক্ষুধা নিয়ে কতদিন পারা যায়।”

অবসরপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তা আরও বলেন, “আমাকে তারা দীর্ঘদিন ধরে কষ্ট দিছে। ঠিকমতো খাইতে দেয় নাই, অসুস্থ হলে ওষুধ পর্যন্ত কিনে দেয় নাই। আমি জীবনে যা আয় করছি ছেলে-মেয়েদের পেছনে খরচ করছি। আমি জানি ছেলে-মেয়ে বড় হবে চাকরি করবে আমাকে দেখবে। কিন্তু তারা কেউই আমাকে দেখছে না।”

ওই বৃদ্ধাশ্রমের আরেক বাসিন্দা আনোয়ারুল ইসলাম দুলাল। নীলফামারীর সৈয়দপুর শহরের ডিসেন্ট টেইলার্স নামক একটি প্রতিষ্ঠানে কাটিং মাস্টার হিসেবে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন তিনি। টানাপোড়েনের সংসার হলেও ছেলে-মেয়েদের পড়িয়েছেন সুনামধন্য স্কুল-কলেজে। স্ত্রীকে একটি স্কুলে পাইয়ে দিয়েছেন চাকরি। তবুও তার ঠাঁই হয়েছে নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রমে।

তিনি সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “আমি এখানে অনেক ভালো আছি। সাজু ভাই নিজের ভাইয়ের মতো দেখেন। সব দিক দিয়ে দেখাশোনা করে তিন বেলা ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া করি। অসুস্থ হলে ওষুধ কিনে দেন। আমার পরিবারের কেউ খোঁজ নেয় না। তাদের কথা না বলাই ভালো।”

রহিমা বেগম নামের বৃদ্ধাশ্রমের আরেক বাসিন্দা বলেন, “আমার স্বামী মারা গেছে। একটা ছেলে ছিল মোরসাইকেল এক্সিডেন্টে মারা গেছে। তারপর এখানে আসছি। এখানে খুব ভালো আছি।”

বৃদ্ধশ্রমটিতে আশ্রিতদের দেখাশোনা করেন উপজেলার রণচণ্ডী এলাকার মনজিলা পারভীন। তিনি সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “আমার বৃদ্ধ মা-বাবাদের সেবা করতে খাওয়াইতে, কথা বলতে, চলতে খুবই ভালো লাগে। আমি মনে করি এই বৃদ্ধদের সেবা-যত্ন করা মানে বাবা-মায়ের সেবা-যত্ন করা। তারা ঠিকমতো খাইছে কি না, দুপুরে ঘুমানোর সময় ঠিকমতো ঘুমাইছে কি না, ঠিকমতো ওষুধ খাইছে কি না এসব আমি দেখাশোনা করি।”

‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার। মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার-ওপার।’... নন্দিত কণ্ঠশিল্পী নচিকেতার এই গান শুনেই অনুপ্রাণিত হয়ে অসহায় বাবা-মার পাশে দাঁড়ানোর সংকল্প করেছিলেন বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা সাজেদুর রহমান সাজু। স্বপ্ন বুননের সমাপ্তি ঘটিয়ে তা বাস্তবায়ন করেন ২০১৮ সালে। পেশায় ব্যবসায়ী সাজু কিশোরগঞ্জের বড়ভিটা ইউনিয়নের সামসুল হকের ছেলে।

কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় মাস্টার্স পাস করে নিজ গ্রামে কীটনাশকের ব্যবসা করে উপার্জিত টাকা দিয়ে নিজের জায়গায় কিশোরগঞ্জ সরকারি কলেজ-সংলগ্ন পাঁচটি টিনশেড ঘর নির্মাণ করেন। স্বপ্নের বৃদ্ধাশ্রমটির নাম দেন ‘নিরাপদ’ বৃদ্ধাশ্রম।

সাজেদুর রহমান সাজু সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “আমার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে অসহায় বৃদ্ধ বাবা-মাকে তাদের নিজ সন্তানের কাছে ফেরত দেওয়া। আমি গত সপ্তাহ পর্যন্ত ২৮ জন বাবা মাকে তাদের সন্তানের কাছে ফেরত দিতে পেরেছি। এখানে সকল বাব-মায়ের থাকা-খাওয়া, কাপড়, চিকিৎসা সবই ফ্রি। সবার সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠানটি চলছে। আমি বৃদ্ধ মা-বাবাদের সেবার মাধ্যমে আনন্দ পাই।”

তিনি আরও বলেন, “নতুন করে গত সপ্তাহে দুইজন বাবা এখানে এসেছেন। একজন বাবা আব্দুল মান্নান উনি যখন স্ট্রোক করেছিলেন তখন তার পরিবারের সবাই ঢাকায় চলে গেছে। আরেকজন হলেন বিএডিসির অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনোয়ারুল মমিন। তিনি আসার পর ফেসবুকে পোস্ট করে তার পরিবারের খোঁজ করার চেষ্টা করছি। তার সন্তানদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। তারা যদি ভুল বুঝতে পেরে তাদের বাবাকে এখান থেকে নিয়ে যায় আলহামদুলিল্লাহ।”

কিশোরগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ মো. আবুল কালাম বারী (পাইলট) সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “যদিও বৃদ্ধাশ্রম আমাদের কখনই কাম্য নয়। আমাদের বাবা-মায়ের শেষ জায়গা বৃদ্ধাশ্রম হওয়া উচিন নয়। তারপরও সমাজের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে এরকমটা হচ্ছে। এটা একটি বড় সিদ্ধান্ত বড় মনের মানুষ বিধায় সাজু এ কাজটা করতে পেরেছে। অনেক পরিশ্রম সাজু করেছেন এই বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে। সমাজের অনেক বিত্তবান ভালো মনের মানুষ এই বৃদ্ধাশ্রমে এগিয়ে এসেছেন। বৃদ্ধাশ্রমের আরও অনেক কাজ বাকি। যে কাজগুলো করতে এলাকা ও বাইরের বিত্তবানরা এগিয়ে এলে তার এই বৃদ্ধাশ্রমটি এগিয়ে যাবে।”

Link copied!