‘দুইটি হাত উঠায়া আপনাদের কাছে দাবি জানাই, আপনারা আমাগরে বাঁচান। নদী থেকে আপনারা আমাগরে বাঁচান, সব ভাইঙ্গা লইয়া যাইতেছে।’ মেঘনা নদীর ভয়াবহ ভাঙন থেকে নিজের ভিটেমাটি রক্ষা করার জন্য নদীতীরে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের দেখে এভাবেই আকুতি-মিনতি করে কথাগুলা বলছিলেন ভোলার মাঝেরচরের হতদরিদ্র মো. সেলিম।
দ্বীপজেলা ভোলার শস্যভাণ্ডার খ্যাত মেঘনা নদী বেষ্টিত সদর উপজেলার বিচ্ছিন্ন কাচিয়া ইউনিয়নের মাঝেরচরে গত ২ মাসে দুপাশে প্রায় ৯ কিলোমিটার এলাকার কয়েক হেক্টর ফসলি জমিসহ ভেঙেছে অনেকের ভিটেমাটি। নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে এই চরে বসবাসকারী দুই গ্রামের প্রায় ৮ হাজার মানুষের।
জানা গেছে, কাচিয়া ইউনিয়নের ৭, ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ড মেঘনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে ৯০ দশকে ফের জেগে উঠলে শুরু হয় বসতি। গড়ে ওঠে রামদেবপুর ও মধুপুর গ্রাম। তখন থেকেই সেখানে পুনরায় বসবাস শুরু করেন ভিটেমাটি হারানো মানুষ। এই চরে রয়েছে ৬টি গুচ্ছগ্রাম, ২টি মুজিব কিল্লা, ৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তিনটি মসজিদ, ২ হাজার বসতঘরসহ নানান স্থাপনা। প্রায় ৩ যুগ পর ফের এ চরে ভয়াবহ নদী ভাঙন শুরু হওয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে বসতিসহ স্থাপনাগুলো।
সরেজমিনে নদী ভাঙনের কবলে পড়া মাঝেরচর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, উত্তাল মেঘনা নদীতীরে একের পর এক ঢেউ আচড়ে পড়ছে। ঢেউয়ে ভাঙছে মাটি। বড় বড় ফাটল ধরেছে চরের প্রায় ১০-১২টি অংশে। ইতোমধ্যে বিলীন হয়েছে অনেকের ভিটেমাটি ও ফসলি জমি। ভাঙন ধরেছে ছয়টি গুচ্ছগ্রামের একটিতে।
নদী ভাঙনের ভয়ে অন্যত্র বসতঘর সরিয়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। যারা ভাঙন থেকে বসতঘর রক্ষা করতে পারেননি, তারা নদী পাড়ে বসে আর্তনাদ করছেন।
তবে নদী ভাঙনরোধে ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে স্থানীয়দের মাঝে।
চরের বাসিন্দা মো. মহিউদ্দিন বলেন, “নদী আগে ১ থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে ছিল। এখন অতিদ্রুত ভাঙছে। নদী আমাদের বাড়িঘর নিয়ে গেলে আমরা কোথায় থাকব?”
হাসিব নামের এক যুবক বলেন, “এই মাঝেরচরে আমার বাপ-দাদার ঘর। নদী ভাঙতে ভাঙতে আমাদের ঘরের কাছাকাছি আইসা পড়ছে। যেকোনো মুহূর্তে আমাগো ঘরবাড়ি ভাইঙ্গা লইয়া যাইতে পারে।”
নাগর লক্ষ্মণ নামে একজন বলেন, “নদী এই পর্যন্ত আমাগরে ৭/৮বার ভাঙছে। দেশে আমাগো জায়গা নাই জমি নাই। সরকার যদি আমাগরে নদী ভাঙা থেকে রক্ষা না করে তাহলে আমরা কোথায় যামু? সরকারের কাছে আমাদের আকুল আবেদন, আমাদেরকে রক্ষা করেন।”
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (পওর-১) মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান বলেন, “উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও পরিবেশগত কারণে মাঝেরচরে নদী পাড়ে ভাঙন দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি এ ভাঙন বেশি দেখা গেছে। ভাঙনকবলিত মাঝেরচর খুব শিগগিরই ভিজিটে গিয়ে সার্ভে করে নদী ভাঙনরোধে প্রকল্প প্রণয়ন করব।”
মেঘনা নদী থেকে সরকারিভাবে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের কারণে ভাঙন দেখা দিয়েছে- চরবাসীর এমন অভিযোগের বিষয়ে পাউবোর এ প্রকৌশলী বলেন, “মেঘনা নদীর নির্দিষ্টস্থানে সরকারিভাবে বালু মহল ঘোষণা করা আছে। নির্দিষ্টস্থানের বাইরে গিয়ে বালু উত্তোলন করলে সেটি পুরো ভোলার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আমি বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে আলাপ করব। একই সঙ্গে যৌথভাবে মনিটরিং করব। নির্ধারিত সীমানার বাইরে গিয়ে বালু উত্তোলন করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”