লক্ষ্মীপুরে গত বছরের তুলনায় সুপারির উৎপাদন কমছে, যা স্থানীয় কৃষকদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ুর পরিবর্তন, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যা, যত্রতত্র ইটের ভাটার কারণে পরিবেশ দূষিত হয়ে এবং বিভিন্ন রোগবালাইয়ের কারণে সুপারি গাছে ফলন উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় কৃষক ও কৃষি বিভাগ।
নারকেল-সুপারিতে ভরপুর মেঘনা উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুর’—এই প্রবাদের সঙ্গে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও রয়েছে। কারণ জেলার ৭ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে উৎপাদিত সুপারিতে ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি লেনদেনের সম্ভাবনা রয়েছে। গাছ থেকে সুপারি পাড়া, বিক্রি ও সংরক্ষণের জন্য এই মৌসুমে জেলায় কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়। সুপারি উৎপাদনেও দেশসেরা লক্ষ্মীপুর। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম-খুলনা-ময়মনসিংহেও পাঠানো হয় এখানকার সুপারি।
এদিকে এবার একেকটি সুপারি দুই থেকে তিন টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছেন কৃষকরা। ব্যবসায়ীরাও লাভের আশায় সুপারি কিনে মজুত করছেন। তবে ব্যবসায়ীদের মাঝে লাভের চেয়ে লোকসানের আশঙ্কা বেশি। গেল বছর লোকসান হওয়ায় এবারও তারা সেই শঙ্কায় ভুগছেন। জেলা শহরের উত্তর তেমুহনী ও সদর উপজেলার চররুহিতা ইউনিয়নের রসুলগঞ্জ বাজার ও দালাবাজারের প্রায় কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
অন্যদিকে এবার সারা দেশের মতো লক্ষ্মীপুরে বৃষ্টি কম হয়েছে। এতে সুপারি আকারে ছোট হয়েছে। উৎপাদনও কম হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। তবে সুপারির দাম কমেনি। স্বল্প সুপারিতে কৃষকরা প্রচুর লাভবান হয়েছেন। সুপারি বাগান কারো পরিকল্পিত সৃষ্টি নয়। এসব সুপারি বাগান বা সুপারি গাছ পূর্ব পুরুষের লাগানো এবং বাড়ির আশপাশে ছড়িয়ে থাকা গাছ থেকেই উৎপাদিত হয়। তবে কিছু সচেতন ব্যক্তি রয়েছেন, যারা বছরে একাধিকবার বাগানের আগাছা পরিষ্কার করেন। এ ছাড়াও গাছের আশপাশে সার ও কিটনাশক ব্যবহার করেন।
লক্ষ্মীপুর পৌরসভা ও রসুলগঞ্জ এলাকার ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুরো জেলা থেকেই তারা সুপারি সংগ্রহ করেন। একেকটি সুপারি দুই-তিন টাকা পর্যন্ত কিনতে হয়েছে। আকার অনুযায়ী প্রতি পোণ (৮০টি) সুপারি ১৮০-২৪০ টাকা পর্যন্ত কিনেছেন তারা। এতে প্রতি কাউন (১৬ পোন) সুপারি ২৬০০-৩৮০০ টাকা পড়েছে। তারা সুপারি ভিজিয়ে ও শুকিয়ে বিক্রি করেন। এ সব প্রক্রিয়াজাত করতে প্রতি কাউন সুপারিতে আরও ২-৩ হাজার টাকা খরচ পড়বে। এবার জেলায় বৃষ্টি কম হওয়ায় ও ভয়াবহ বন্যা, যত্রতত্র ইটের ভাটার কারণে, সুপারি উৎপাদন কম হয়েছে। এ জন্য বাজারে সুপারি কম, দামও বেশি। গতবার তারা বেশি দামে সুপারি ক্রয় করলেও, লোকসানে বিক্রি করতে হয়েছে। এবারও দাম কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ, রায়পুর, সদর, রামগতি ও কমলনগর উপজেলার প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় সুপারি বিক্রি করতে দেখা যায় কৃষক ও গৃহস্থদের। আর সাপ্তাহিক হাটগুলো জমে ওঠে সুপারি ব্যবসায়ী ও কৃষকদের উপস্থিতিতে। গ্রামের গৃহবধূদেরও সুপারি বিক্রি করতে হাটে দেখা যায়।
সুপারির বড় বাজারগুলোর মধ্যে রয়েছে রায়পুর উপজেলার হায়দরগঞ্জ, খাসেরহাট, মোল্লারহাট, মিতালীবাজার, আলিয়া মাদ্রাসা মাঠ, রামগঞ্জ উপজেলার মীরগঞ্জ, পানপাড়া, কাঞ্চনপুর, দল্টা, সদর উপজেলার দালালবাজার, রসুলগঞ্জ, চন্দ্রগঞ্জ, মান্দারী, কমলনগর উপজেলার হাজিরহাট, রামগতি উপজেলার আলেকজান্ডারে সবচেয়ে বড় অস্থায়ী সুপারির বাজার বসে। চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা লক্ষ্মীপুরে এসে সুপারি কিনে নানা প্রান্তে নিয়ে যান। সেখান থেকে আবার বিদেশেও পাঠাচ্ছেন আড়তদাররা।
সদর উপজেলার সুপারি ব্যবসায়ী ও বাগান মালিক সমিতির কোষাধ্যক্ষ মো. আলমগীর হোসেন বলেন, “অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যা, যত্রতত্র ইটের ভাটার কারণে পরিবেশ দূষিত হয়ে এবং বিভিন্ন রোগ-বালাইয়ের কারণে সুপারি গাছে ফলন ও উৎপাদন এবার কম হয়েছে। যার কারণে প্রতি পিচ সুপারি ২-৩ টাকায় ক্রয় করতে হচ্ছে। গত বছর আমরা বেশি দামে সুপারি ক্রয় করলেও, লোকসানে বিক্রি করতে হয়েছে। এবারও দাম কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।”
মৌসুমী সুপারি ব্যবসায়ী মাসুদ খান বলেন, “৮০ হাজার টাকায় একটি সুপারি বাগান লিজ নিয়েছিলাম। কিন্তু বৃষ্টি না হওয়ায় ও বন্যার কারণে উৎপাদন কম হয়েছে। ওই বাগান থেকে মাত্র ২০ হাজার টাকার সুপারি বিক্রি করতে পেরেছি। এ ছাড়া ব্যবসার উদ্দেশ্যে ৩০০ কাউন সুপারি কিনে সংরক্ষণ করেছি। প্রতি কাউন সুপারি ৩৪০০ টাকা পড়েছে।”
রামগঞ্জ এলাকার স্থানীয় কৃষক শাহাদাত হোসেন জানান, “গত বছর আমার বাগানে যে পরিমাণ সুপারি হয়েছিল, এ বছর তার অর্ধেকও হয়নি। গাছের পরিচর্যা ঠিকমতো করেও ফলন বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। এক মাসে তিনি চার লাখ টাকার সুপারি বিক্রি করেছি। গাছে আরও প্রায় এক লাখ টাকার সুপারি আছে। সব মিলিয়ে তিনি এবার ৫ লাখ টাকার সুপারি বিক্রি করা সম্ভব হবে। গত বছর বাগানের সুপারি বিক্রি করে ৯ লাখ টাকা পেয়েছিলাম।”
রামগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সৈয়দ রায়হানুল হায়দার বলেন, “কৃষকদের আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি গ্রহণ এবং কীটনাশকের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। গত বছর যেখানে রামগঞ্জ ৬ হাজার মেট্রিক টন সুপারি উৎপাদন হয়েছিল, সেখানে এ বছর তা নেমে এসেছে ৩ থেকে ৪ হাজার মেট্রিক টনে। সারা বছর গাছে সুপারি ধরলেও সুপারি উৎপাদনের ভরা মৌসুম ধরা হয় অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মাস। আগামী জানুয়ারী মাস পর্যন্ত সুপারির বেচাবিক্রি চলবে।”
জেলা কৃষি বিভাগ জানায়, লক্ষ্মীপুরে ৭ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে সুপারি বাগান রয়েছে। এবার সুপারি থেকে হাজার কোটি টাকা আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।
এ ব্যাপারে লক্ষ্মীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সোহেল মো. শামছুদ্দিন ফিরোজ বলেন, উপকূলীয় জেলা হওয়ায় এখানে সুপারি চাষ বেশি হয়। এবার একেকটি সুপারি দুই থেকে তিন টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। গত বছরের ছেয়ে উৎপাদন কম হলেও সুপারি বিক্রিতে এবার ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি লেনদেনের সম্ভাবনা রয়েছে। সুপারি পাড়া থেকে শুরু করে সংরক্ষণ ও বিক্রি পর্যন্ত এ এলাকার কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়।