পুরস্কারের আশায় সাপ ধরে হুলস্থুল কাণ্ড...


ফরিদপুর প্রতিনিধি
প্রকাশিত: জুন ২৩, ২০২৪, ০৯:১৭ পিএম
পুরস্কারের আশায় সাপ ধরে হুলস্থুল কাণ্ড...

ফরিদপুরের এক কৃষক ৫০ হাজার টাকা পুরস্কারের আশায় জীবিত রাসেলস ভাইপার ধরে চরম বিপদে পড়েছেন। পুরস্কার তো জোটেইনি, উল্টো হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। অনেকে আবার তাকে তিরস্কারও করছেন।

ঘটনাটা শুরু ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম হকের এক ঘোষণাকে কেন্দ্র করে। গত ২০ জুন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনের প্রস্তুতি সভায় আলোচনার মধ্যে জেলা সভাপতি হঠাৎ ঘোষণা করে বসেন, “রাসেলস ভাইপার সাপ মারতে পারলে তাকে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।”

মারতে পারলে পুরস্কার
সভাপতির ঘোষণা খানিকটা সংশোধন করে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইশতিয়াক আরিফ বলেন, “শুধুমাত্র কোতোয়ালি থানার মধ্যে কেউ রাসেলস ভাইপার মারতে পারলে তাকে আমাদের সভাপতি সাহেব পুরস্কার দেবেন।”

জেলার শীর্ষ নেতাদের এমন ঘোষণার পর হুলস্থুল কাণ্ড বেঁধে যায়। পুরস্কার পেতে জেলাব্যাপী সাপ মারার উৎসাহ ছড়িয়ে পড়ে। শত শত ব্যক্তি উন্মুক হয়ে ওঠেন সাপ ধরতে। এরই মধ্যে ঘোষণার পরদিন শুক্রবার (২১ জুন) জেলা সদরের দুর্গম চরে জমিতে ঘাস কাটার সময় রাসেলস ভাইপার দেখতে পান মুরাদ মোল্লা (৪৩) নামে এক কৃষক।

লাঠি দিয়ে সাপটি মারার পর তিনি সেটি নিয়ে পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে সিএন্ডবি ঘাটে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি আনোয়ার হোসেন আবু ফকিরের অফিসে আসেন। খবর পেয়ে সেখানে ছুটে আসেন সাংবাদিকরা। আবু ফকির তখন সবার সামনে জানিয়ে দেন যে, মুরাদ মোল্লাকে জেলা সভাপতি ঘোষিত পুরস্কার দেওয়া হবে।

তবে এর মধ্যেই ঘটনা তালগোল পাকিয়ে যায়, যখন বন বিভাগের কর্মকর্তারা ঘটনা জানার পর সাফ বলে দেন, সাপ মারা আইনসিদ্ধ নয়। কর্মকর্তারা জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের পুরস্কার ঘোষণার বিষয় নিয়ে সমালোচনাও করেন। এতে বিপাকে পড়েন নেতারা।

জীবিত ধরলে পুরস্কার
দিশেহারা হয়ে নেতারা আগের ঘোষণা থেকে সরে এসে বলেন, রাসেলস ভাইপার মেরে ফেললে নয়, বরং জীবিত অবস্থায় ধরে আনতে পারলে ৫০ হাজার টাকা করে পুরস্কার দেওয়া হবে।

ঘোষণা অনুযায়ী, শুক্রবার (২১ জুন) সন্ধ্যায় জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক সৈয়দ আলী আশরাফ পিয়ার স্বাক্ষর করা একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ফরিদপুর সদর উপজেলাধীন কেউ যদি নিজেকে রক্ষাকারী পোশাক সম্বলিত হয়ে এবং সব ধরনের সাবধানতা অবলম্বনপূর্বক জনস্বার্থে রাসেলস ভাইপার সাপ জীবিতাবস্থায় ধরতে পারেন, তবে তাকে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।”

ঘোষণার সঙ্গে এমন বাড়তি বিজ্ঞপ্তিতে কাজের উৎসাহ বেড়ে যায়। চারদিকে হৈচৈ পড়ে যায়। এবার মৃত নয়, জীবিত সাপ ধরার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। শেষ অবধি ঘটনা গড়ায় পরদিন শনিবার (২২ ‍জুন) বিকেলে।

প্রেসক্লাবে সাপের পাতিল
ফরিদপুর সদরের সাইন বোর্ড এলাকার বাসিন্দা মনোরুদ্দিন খানের ছেলে কৃষক রেজাউল খান (৩২) তার ফসলি জমি চাষ করার সময় সাক্ষাৎ পেয়ে যান আরেক রাসেলস ভাইপারের। তবে তিনি মুরাদ মোল্লার মতো ভুল করেননি। স্থানীয়দের সহায়তায় রেজাউল সাপটিকে অ্যালুমিনিয়ামের পাতিলে ভরে ফেলেন। আর প্লাস্টিকের নেটের আবরণ দিয়ে পাতিলের মুখ বন্ধ করে দেন।

এবার ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার পাওয়ার আশায় বুক বাঁধেন। তবে ঘটনার জন্য তো সাক্ষী দরকার। সেজন্য পাতিল নিয়ে সোজা চলে আসেন ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সামনে। জীবিত প্রায় ১৮ ইঞ্চি লম্বা রাসেলস ভাইপারের বাচ্চাটি সাংবাদিকদের সামনে উন্মুক্ত করেন। যেখানে প্রেসক্লাবের সাংবাদিকরা ছাড়াও হাজির ছিলেন পৌরসদরের ২৫নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর সৈয়দ আওয়াল হোসেন তনু। এবার তো নিশ্চিত পুরস্কার পাওয়ার পালা।

প্রাপ্তিস্বীকারপত্র চাই
কৃষক রেজাউলের সাপ ধরার পুরস্কার নিশ্চিত করতে কাউন্সিলর আওয়াল হোসেন ফোন দেন পুরস্কারের ঘোষক জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম হককে। তবে সভাপতি সব শুনে সাপটি বনবিভাগে জমা দিয়ে প্রাপ্তিস্বীকারপত্র নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে যেতে বলেন।

সাপ ধরে পুরস্কার পাওয়ায় আসায় সাহসী হয়ে ওঠা কৃষক রেজাউল দমে যাওয়ার পাত্র নন। তিনি রোববার (২৩ জুন) দুপুরে সাপটি নিয়ে সোজা চলে যান বন বিভাগের বিভাগীয় কার্যালয়ে। তবে সাপটি জমা দিয়ে প্রাপ্তিস্বীকারপত্র চাইলে বন কর্তকর্তারা অপারগতা প্রকাশ করে বসেন।

সাপ ধরাটাই অপরাধ
সাংবাদিকরা তো সাক্ষী, রেজাউলকে তো পুরস্কার পাইয়ে দিতেই হবে। সেজন্য ফরিদপুরের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা গোলাম কুদ্দুস ভূঁইয়ার কাছে তারা কারণ জানতে চান। এতে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বলেন, “সরীসৃপজাতীয় প্রাণী ধরার কোনো বিধান নেই। সাপ ধরাটাই অপরাধ। কারও জালে সাপ আটকে গেলে সে অন্য কথা।”

ফরিদপুরের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আরও বলেন, “আমি প্রাপ্তিস্বীকারপত্র দিতে পারি না। পুরস্কারের আশায় সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অন্তত তিনজন এক হাত লম্বা রাসেলস ভাইপারের বাচ্চা জমা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। যা নিয়ে আমরা বিপদে পড়েছি।”

যেখান থেকে ধরা, সেখানে গিয়ে ছাড়া
গোলাম কুদ্দুস ভূঁইয়া সাফ বলে দেন, “এ ধরনের পুরস্কার ঘোষণা করাটা অবৈধ। মানুষকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা। আমরা এটা প্রমাণ করতে যাব কেন? ওই কৃষকের উচিত হবে যেখান থেকে সাপটি ধরেছে ওই স্থানে ছেড়ে দেওয়া।”

এরপর রেজাউল কীভাবে পুরস্কার পাবেন সে বিষয়ে জানতে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. ইসতিয়াক আরিফের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

কোনো পুরস্কার নেই
তবে এর মধ্যেই দুপুরে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম হক তার ফেসবুক পোস্টে পুরস্কারের ঘোষণা প্রত্যাহারের বিষয়টি সবাইকে জানিয়ে দেন। পোস্টে লেখেন, “জীবিত বা মৃত কোনো প্রকার রাসেলস ভাইপারের জন্য কোনো পুরস্কার নেই। বর্তমানে রাসেলস ভাইপার অত্যন্ত বিপজ্জনক, তাই যেকোনো পুরস্কার বা কৌতূহলবশত এ সাপ নিয়ে অতি উৎসাহী হবেন না। জীবিত বা মৃত কোনো প্রকার রাসেলস ভাইপারের জন্য কোনো পুরস্কার নেই।”

শামীম হক আরও লেখেন, “সাপ দেখলে তা ধরা বা মারার চেষ্টা করবেন না। প্রয়োজনে জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩ নম্বরে কল করুন। অথবা নিকটস্থ বন বিভাগের অফিসকে অবহিত করুন।”

সাপ ধরে মাথায় হাত
এতসব কাণ্ডের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন বিষধর রাসেলস ভাইপারকে পাতিলে ভরে পুরস্কারের আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ানো কৃষক রেজাউল। তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যেখান থেকে সাপটি ধরেছেন সেখানে ছাড়িয়ে দিতে। বেচারা এখন কী করবেন, তা নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।  
 

Link copied!