বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় শেষ জেলা সাতক্ষীরা। জেলার সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো দিন দিন চিকিৎসকশূন্য হয়ে পড়ছে। সাতক্ষীরায় ২১৮ জনের বিপরীতে ৭৪ জন চিকিৎসক কর্মরত আছেন। বাকি ১৪৪টি চিকিৎসকের পদই শূন্য। ফলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন না জেলার সাধারণ মানুষ।
জেলায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকটের কারণে রোগীদের একটি বড় অংশ মোটা অংকের টাকা খরচ করে চিকিৎসা নিতে চলে যাচ্ছেন ভারতে। সাতক্ষীরার ভোমরা শুল্ক স্টেশন দিয়ে প্রতিদিন ভারতে যাওয়া পাসপোর্ট যাত্রীদের প্রায় ৩২ শতাংশ মেডিকেল ভিসায় যাচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সাতক্ষীরা সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল, সাতক্ষীরা বক্ষব্যাধি ক্লিনিক, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কার্যালয় ও ইউএসসি সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে মোট ২১৮টি চিকিৎসকের পদ রয়েছে। এসব পদের মধ্যে মাত্র ৭৪ জন চিকিৎসক কর্মরত। বাকি ১৪৪টি অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পদই শূন্য রয়েছে। আবার কোনো কোনো চিকিৎসকের কর্মস্থল জেলা সদরের বাইরে হওয়ায় তারা সময় দেন না। এমনকি ইউএসসি কেন্দ্রের চিকিৎসকদের চেনেন না স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এলাকাবাসী। ফলে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব, পদ শূন্য ও ইউএসসিতে কর্মরত চিকিৎসকরা কর্মস্থলে উপস্থিত না হওয়ায় সঠিক স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন গ্রামীণ জনপদের সাধারণ মানুষ। জেলার নাগরিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা সকলেই এমন অভিযোগ করেছেন।
সূত্র আরও জানায়, সাতক্ষীরা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে চিকিৎসকের পদ রয়েছে তিনটি। এর মধ্যে মেডিকেল অফিসারের পদ শূন্য রয়েছে। সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে চিকিৎসকের পদ রয়েছে ২৭টি। এর মধ্যে সিনিয়র কনসালটেন্ট (চক্ষু), সিনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারি), সিনিয়র কনসালটেন্ট (অ্যানেসথেসিয়া), জুনিয়র কনসালটেন্ট (গাইনি), জুনিয়র কনসালটেন্ট (পেডরিয়াট্রিক্স), জুনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), জুনিয়র কনসালটেন্ট (প্যাথলজি), জুনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারি), জুনিয়র কনসালটেন্ট (বিষয়বিহীন) জুনিয়র কনসালটেন্ট (রেডিওলজিস্ট), এমওসহ (আয়ুর্বেদী) ১১ জন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পদই শূন্য রয়েছে।
জেলার একমাত্র বক্ষব্যাধি ক্লিনিকের দুইটি পদের মধ্যে জুনিয়র কনসালটেন্ট, বক্ষর পদ দীর্ঘ দিন ধরে শূন্য। সাতক্ষীরা সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কার্যালয়ে তিনটি পদ থাকলেও জুনিয়র কনসালটেন্ট (অ্যানেসথেসিয়া) ও মেডিকেল অফিসারের (ডিসি) পদ শূন্য।
তালা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের ২১টি পদের মধ্যে আরএমও, জুনিয়র কনসালটেন্ট সার্জারি, মেডিসিন, গাইনি, শিশু, কার্ডিও, চক্ষু, ইএনটি, চর্ম ও যৌন এবং মেডিকেল অফিসার একজন, অ্যানেসথেটিস্ট, প্যাথলজিস্ট, ডেন্টাল সার্জন ও এমওসহ (আয়ুর্বেদী) ১৪ জন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পদ শূন্য রয়েছে।
কলারোয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের ২১টি পদের মধ্যে আরএমও, জুনিয়র কনসালটেন্ট যথাক্রমে অ্যানেসথেসিয়া, মেডিসিন, গাইনি, শিশু, অর্থ, কার্ডিও, চক্ষু, ইএনটি, চর্ম ও যৌন এবং ইনডোর মেডিকেল অফিসার, ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার, অ্যানেসথেটিস্ট, এমও/হোমিও/আয়ু./ইউনানি ও ডেন্টাল সার্জনসহ ১৫ জন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পদই শূন্য রয়েছে।
আশাশুনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের ১০টি পদের বিপরীতে জুনিয়র কনসালটেন্ট যথাক্রমে অ্যানেসথেসিয়া, সার্জারি, মেডিসিন, গাইনি ও মেডিকেল অফিসার একজন, ডেন্টাল সার্জনসহ ছয়জন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পদই শূন্য রয়েছে।
দেবহাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের পদ রয়েছে ২২টি। যথাক্রমে জুনিয়র কনসালটেন্ট অ্যানেসথেসিয়া, সার্জারি, মেডিসিন, গাইনি, শিশু, অর্থ, কার্ডিও, চক্ষু, ইএনটি, চর্ম ও যৌন, শিশু, রে.পার., আরএমও, ডেন্টাল সার্জন, মেডিকেল অফিসার দুইজন, সহকারী সার্জন দুইজনসহ ১৭ জন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পদ শূন্য রয়েছে।
কালিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের ১০টি পদের মধ্যে জুনিয়র কনসালটেন্ট অ্যানেসথেসিয়া, সার্জারি, মেডিসিন, গাইনি এবং ডেন্টাল সার্জনসহ পাঁচজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পদ শূন্য রয়েছে।
শামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের ২১টি পদের মধ্যে আরএমও, জুনিয়র কনসালটেন্ট যথাক্রমে মেডিসিন, সার্জারি, মেডিসিন, শিশু, অর্থ, কার্ডি, চক্ষু, ইএনটি, চর্ম ও যৌন এবং মেডিকেল অফিসার দুইজন, ইনডোর মেডিকেল অফিসার, ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার, অ্যানেসথেটিস্ট, প্যাথলজিস্ট, এমও/হোমিও/আয়ু./ইউনানি ও ডেন্টাল সার্জনসহ ১৭ জন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পদ শূন্য রয়েছে।
সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা কালিগঞ্জ উপজেলার হামিদুর রহমান বলেন, “চোখের ডাক্তার দেখাব বলে আগে একদিন এসেও ফিরে গিয়েছি ডাক্তার না থাকার কারণে। আজ রোগীর অনেক লম্বা লাইন, দীর্ঘ অপেক্ষার পরে ভেতরে গিয়ে দেখি, যাকে দেখাতে চেয়েছিলাম তিনি নেই। একজন ইন্টার্ন ডাক্তার রোগী দেখছে। বাধ্য হয়ে আজও ফিরে যেতে হচ্ছে।”
ভোমরা বন্দরে আসা মিলন গাজী জানান, “আমার বোনের পায়ের সমস্যা। সাতক্ষীরাতে ডাক্তার না থাকায় বোনকে কলকাতায় পাঠাতে এসেছি।”
জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয় সম্পাদক ডা. সুব্রত ঘোষ বলেন, “চাহিদা মাফিক চিকিৎসকের পদ সৃষ্টি না হওয়াসহ নানা জটিলতায় সঠিক স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। আবার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কার্যালয়ও ইউনিয়ন সাব সেন্টারের যে সকল চিকিৎসক দেওয়া হয়, তারা উচ্চ শিক্ষাসহ বিভিন্ন অজুহাতে সেখান থেকে চলে আসে।”
সাতক্ষীরার ভোমরা ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাজরিহা হোসেন জানান, প্রতিদিন গড়ে এক হাজার থেকে ১২০০ লোক বৈধভাবে পাসপোর্টে এই পথ দিয়ে ভারতে যায়। এর মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ মেডিকেল নিয়ে যাচ্ছেন।
সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন ডা. মো. সবিজুর রহমান বলেন, সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালটি ১০০ বেডের হাসপাতাল হলেও এখানে প্রতিদিন দুইশ থেকে আড়াইশ রোগী বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি থাকে। এছাড়াও প্রতিদিন বহির্বিভাগে প্রায় সাড়ে চারশ এবং জরুরি বিভাগে ৭০ থেকে ৮০ জন রোগীকে স্বাস্থ্য সেবা দিতে হয়। সব মিলিয়ে সদর হাসপাতালে প্রতিদিন প্রায় আটশ থেকে নয়শ রোগীকে স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া হয়ে। কিন্তু এসব রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য যে সব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকার কথা সে সব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ দীর্ঘ দিন ধরে শূন্য হয়ে আছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক শূন্য থাকলে সাধারণ চিকিৎসকের কোনো ঘাটতি নেই দাবি করেন সিভিল সার্জন বলেন, জনবল সংকটের বিষয়টি অধিদপ্তরে প্রতি মাসে জানানো হয়। ব্যক্তিগতভাবেও যোগাযোগ করা হয়। ইতোমধ্যে ৪২ বিসিএস থেকে ৫৩ জন মেডিকেল অফিসার সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগদান করেছে।