বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ। এ ঘটনায় নাড়া দিয়ে ওঠে সবার হৃদয়।
আবু সাঈদ মারা যাওয়ার ১১ দিন পর ২৭ জুলাই পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলায় গ্রামের বাড়িতে পুত্র সন্তানের জন্ম দেন সাজু ইসলামের স্ত্রী। মোবাইলে সেই খবর পেয়ে আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে ছেলের নাম রাখতে বলেন আবু সাঈদ।
কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস সেই সন্তানের মুখ আর দেখা হলো না সাজুর। বাড়িতে ফিরলেন লাশ হয়ে।
সাজু ইসলাম পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার চিলাহাটি ইউনিয়নের টোকরাভাসা মীরপাড়া এলাকার আজাহার আলীর ছেলে। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়।
জানা গেছে, পরিবারের স্বচ্ছলতা ফেরাতে গাজীপুরে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন সাজু ইসলাম। পুত্র সন্তান জন্মের ৯ দিনের মাথায় ৫ আগস্ট গাজীপুরের শ্রীপুরের মাওনা এলাকায় আনন্দ মিছিল বের করা হয়। সেই মিছিলে বন্ধুদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন সাজু মিয়া। মাওনা থেকে ছাত্রজনতা মিছিলটি নিয়ে গণভবনের দিকে রওনা হয়। ওই সময় ময়মনসিংহ থেকে পিকআপে করে বিজিবি ও কিছু পুলিশ এসে গুলি করতে থাকে। এ সময় পুলিশের গুলি দুই দফা সাজুর পিঠে লাগে, এতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। দীর্ঘক্ষণ পড়ে থাকার পর স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় সাজুর এক বন্ধু একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেলে নিয়ে ভর্তি করেন।
সাজুর পেটের বাঁ দিকে গুলি ঢুকে পেটের ভেতরে আটকে ছিল। গত ১১ আগস্ট রাতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। ১২ আগস্ট গ্রামের বাড়িতে এনে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় সাজুর লাশ।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, সাজু ইসলাম ২০১৭ সালে স্থানীয় একটি কলেজ থেকে এইএসসি পাশ করেন। এরপর অভাবের সংসারের হাল ধরতে গাজীপুরে একটি টেক্সটাইল মিলে কাজ শুরু করেন। সাজুর বাবা একসময় ঢাকায় রিকশা চালাতেন। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ থাকায় আর রিকশা চালাতে পারছেন না।
সংসারের সব দায়িত্ব ছিল সাজুর ওপর। একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যকে হারিয়ে নির্বাক পরিবারটি। নিজেদের ভিটেবাড়ির ৮ শতাংশ জমি ছাড়া আর কোনো জায়গা নেই তাদের।
সোমবার (২৬ আগস্ট) বিকেলে সাজু ইসলামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছেলের জন্য কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে গেছে মা সামিনা আক্তারের। অন্যদিকে ঘরের ভেতর ১ মাসের ছেলেকে নিয়ে অনবরত চোখের পানি ফেলছেন শারমিন আক্তার। স্বজনদের সমবেদনা যেন কোনো কাজেই আসছে না। বারবার বলছিলেন, “এই ছোট বাচ্চাকে নিয়ে কোথায় যাব আমি, আমার ছেলেরে কে মানুষ করবে? আমি বিচার চাই, আমার স্বামীর খুনিদের বিচার চাই।”
সাজুর মা সামিনা আক্তার বলেন, “আমার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম আমার ছেলে। এখন কে এই পরিবার চালাবে। আমার ছেলে তার সন্তানের মুখ দেখার জন্য হাসপাতালে ছটফট করেছিল, কিন্তু দেখতে পারল না। বারবার বলেছিল- ‘আমি বাঁচব না আমার ছেলেকে একবার দেখতে চাই‘। আমরা তাকে তার ছেলের মুখ দেখাতে পারিনি”- বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
সাজুর বাবা আজহার আলী বলেন, “এই ছেলেটাই আমাদের একমাত্র ভরসা ছিল। ও-ই সংসারটা চালাত। এখন ওর ছোট্ট ছেলেটাকে কীভাবে মানুষ করব, কীভাবে আমাদের সংসার চলবে?”