অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ফয়সাল আহম্মেদ। তার দুই ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। মাসের শুরুতে সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ পাঠাতে হয়। তারপর বাসা ভাড়া দিয়ে অন্যান্য খরচের তালিকা করতে হয় তাকে। তিনি বলেন, “তাতে দেখা যায়, বাজারের জন্য যে খরচ রাখি তা দিয়ে সংকুলান হয় না। বাজারের যে বাড়তি দাম তাতে আমরা মধ্যবিত্তরা পিষ্ট হচ্ছি। এক কেজির রুই মাছ ৪০০ টাকার ওপর চাচ্ছে। তেলাপিয়া ২২০-২৪০ টাকা কেজি। ছোট ছোট ইলিশ ১৫০০- ১৮০০ টাকা কেজি। যেগুলো আগে কিনতাম ৫০০-৫৫০ টাকায়। ডিমের হালি ৫৫-৫৬ টাকা।”
ফয়সাল আহম্মেদের মতো এমন অবস্থা কুমিল্লার মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষের। চলতি বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে বন্যার কারণে নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। সবজি থেকে শুরু করে সব পণ্যের দাম ক্রেতাদের নাগালের বাইরে।
বিক্রেতারা বলছেন, বন্যায় মাছের ঘের,খামারসহ সবজির মাঠ পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সরবরাহ কম থাকায় দামের ওপর প্রভাব পড়েছে। এদিকে ক্রেতাদের অভিযোগ, বাজারে পর্যাপ্ত পণ্য থাকলেও সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে বেশি দামে বিক্রি করছে।
শনিবার (৫ অক্টোবর) সকালে জেলার রানীবাজার, রাজগঞ্জ, পদুয়া বাজার বিশ্বরোড বাজারগুলো সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, মাছবাজারে প্রচুর ক্রেতার ভিড়। কিন্তু সে তুলনায় পর্যাপ্ত মাছ নেই।
এর কারণ হিসেবে বিক্রেতারা জানান, জেলার প্রায় ৫০ হাজারেরও বেশি মাছের ঘের, খামারসহ পুকুর, জলাশয় বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় চাষ করা মাছ ভেসে যায়। ফলে স্থানীয়ভাবে যেসব মাছ সরবরাহ হতো, তা না আসায় বাজারে একটা সংকট সৃষ্টি হয়েছে। তা ছাড়া অন্যান্য জেলা থেকেও যেসব মাছ আসত, তা কমে যাওয়ায় বাজারে এর প্রভাব পড়েছে।
ভরা মৌসুমে ইলিশ বাজারে নেই। যেটা আছে তাও বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দামে। যা সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে।
অন্যদিকে সবজির বাজারে দেখা যায়, মৌসুমী সবজির সরবরাহ কম থাকায় বাজারে ক্রেতাদের বাড়তি দামে সবজি কিনতে হচ্ছে। তুলনামূলকভাবে বাজারে সবজি কম থাকাই দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।
পাশের জেলা ফেনীতে সবজির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু এবারের বন্যায় ফেনী আক্রান্ত হওয়ায় সবজির মাঠ তলিয়ে যায়। ফলে সেখানেও সবজির ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় এর প্রভাব কুমিল্লার বাজারে পড়েছে। জেলার শস্যভান্ডার হিসেবে খ্যাত গোমতিচর ও চান্দিনা উপজেলার নিমসার বাজার কৃষিখাত সম্পূর্ণ বন্যার কবলে পড়াও আরেকটি কারণ। যার প্রভাব পড়ছে বাজারে।
সর্বনিম্ন ৫০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২৩০ টাকা পর্যন্ত কেজি ধরে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের সবজি।
মুরগির বাজারে দেখা যায়, গত সপ্তাহে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজি প্রতি ১৪০-১৬০ টাকা থাকলেও এই সপ্তাহে তা বেড়ে ২২০-২৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। লেয়ার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৩২০ টাকা কেজি দরে। কক মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২৬০-২৮০ টাকায়।
মুদিপণ্যের বাজারও অস্থিতিশীল। প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন ক্রেতারা। পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, মরিচ, চাল, ডালসহ অন্যান্য যেসব মুদি পণ্য রয়েছে সব কিছুর দামই বাড়তি। ফলে বিড়ম্বনায় রয়েছে নিম্নবিত্ত থেকে শুরু উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবার।
তসলিম ইসলাম নামে একজন ব্যাংকার বলেন, “যে বেতন পাই তা দিয়ে বাসা ভাড়া, সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ, প্রাইভেট শিক্ষকের খরচসহ সাংসারিক অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে বাজার খরচ রাখতে হয়। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় দেখা যাচ্ছে সাধ্যের ভেতরেও বাজার করতে হিমশিম খাচ্ছি। একটি পণ্য কিনতে গেলে অন্য পণ্য কেনা যায় না। বাসা থেকে বলেছে গরুর মাংস কিনতে, কিন্তু যে দাম তাতে সাহস পাচ্ছি না। মাংস কিনতে গেলে অন্যান্য বাজার আর করা হয় না।”
কবির হোসেন নামে এক প্রবাসী বলেন, কষ্ট করে প্রবাসে কাজ করি। সন্তানরা ভালো স্কুলে পড়ে তার জন্য শহরে বাসা ভাড়া নিয়েছি। যে টাকা আয় করি তার কিছু অংশ নিজের জন্য রেখে দেশে পাঠিয়ে দিই। কিন্তু বাজারের দামের যে অবস্থা তাতে আমার পরিবার কিভাবে চলে, তা আমি বাজারে না আসলে বুঝতাম না। আয়ের সাথে ব্যয়ের কোনো সঙ্গতি নেই। সব কিছুতেই বাড়তি দাম। কোনটা রেখে কোনটার কথা বলব।
তাহমিনা আক্তার নামে একজন গৃহিণী বলেন, “স্বামীর যে আয় তা দিয়ে কোনো রকমে চলছি। খরচের সাথে পেরে উঠতে পারছি না। অনেক সময় সন্তানদের আবদার রক্ষা করতে পারি না।”
তিনি বাজার মনিটরিংয়ের দাবি জানান।
শিবলী আহম্মেদ নামে একজন মুদি ব্যবসায়ী বলেন, আমরা খুচরা বিক্রি করি। আড়ত থেকে যে দামে কিনি, সঙ্গে পরিবহন খরচ ও শ্রমিক মজুরি দিয়ে সঙ্গতি রেখেই বিক্রি করি।
সুবেল নামে সবজি ব্যবসায়ী বলেন, “বন্যায় আমাদের এখানে সব মাঠ ডুবে সবজি নষ্ট হয়ে গেছে। অন্য জেলা থেকেও তেমন আসছেনা। বেশি দামে আমাদের কিনতে হচ্ছে।”
ফজলু নামে মাছ ব্যবসায়ী বলেন, “নোয়াখালীর সব খামার ডুবে মাছ ভেসে গেছে। যশোর, সাতক্ষীরা, লক্ষ্মীপুর, ফেনী থেকে মাছ আসছে না। বাজারে মাছের সংকট। আমরা খুচরা ব্যবসায়ীরাও আছি আরো সংকটে। বেশি দামে কিনে বিপদে আছি। ক্রেতারা যে দাম বলে সে দামে বিক্রি করলে লোকসান হবে।”
জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আছাদুল ইসলাম বলেন, “আমরা অভিযোগ পেলেই অভিযান চালাই। তাছাড়া আমাদেরও নিয়মিত বাজার মনিটরিং চলছে।”
জেলা প্রশাসক মো.আমিরুল কায়ছার বলেন, “বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রশাসনের নজরদারি রয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা যাতে বাজার অস্থিতিশীল করতে না পারে সে জন্য আমরা মাঠ পর্যায়ে নির্দেশনা দিয়েছি।”