পিরোজপুর জেলা শহর থেকে ৩ কিলোমিটার উত্তরে রায়েরকাঠিতে ২০০ একর জমি নিয়ে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী রায়েরকাঠি জমিদারবাড়ি। এখানে আছে ১৬৬৮ সালে নির্মিত কালীমন্দির, ১১টি মঠ ও ধ্বংসপ্রাপ্ত রাজবাড়ি। ধ্বংসপ্রাপ্ত এসব মঠ ও রাজবাড়ি দেখেও পর্যটকরা মুগ্ধ হতে বাধ্য।
প্রতিদিনই কিছু দর্শনার্থী আসেন, ইট ও চুন-সুরকি দিয়ে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তৈরি করা সপ্তদশ শতাব্দীর এই মনোরম নির্মাণশৈলী এই প্রাসাদ ও মঠগুলো দেখতে। কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ৪০০ বছরের পুরোনো কালীমন্দির ও ৭৫ ফুট উঁচু ১১টি মঠ।
ইতিহাস গবেষক গোলাম মোস্তফার ‘সংগ্রামী পিরোজপুর’ বইয়ে পাওয়া যায়, ১৬১৮ সালে সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে সেলিমাবাদ পরগনার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পান মদন মোহন। ১৬২৮ সালে তার ছেলে শ্রীনাথের নামে সেলিমাবাদ পরগনার কিছু জমি নেন। শ্রীনাথ ঝালকাঠির লুৎফাবাদ গ্রামে কাচারি স্থাপন করে বসবাস করতেন।
১৬৫৮ সালে রাজা শ্রীনাথ রায়ের ছেলে রুদ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী পিরোজপুরের অদূরে বসবাস শুরু করেন। পরে সেখানে তিনি জঙ্গল পরিষ্কার করে রাজবাড়ি ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। বন-জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা হয় বলেই সেখানকার নামকরণ করা হয় রায়েরকাঠি।
রাজা রুদ্র নারায়ণ কালীমন্দির প্রতিষ্ঠার সময় পাঁচজন নিম্নবর্ণের হিন্দুর মুণ্ডু কেটে তার ওপর মূর্তি স্থাপন করেন। রাজার এ নিষ্ঠুর ঘটনা ঢাকার প্রাদেশিক সুবেদার শাহবাজ খানের কানে পৌঁছালে রুদ্র নারায়ণকে মৃত্যুদণ্ড দেন। কিন্তু ঘটনাক্রমে তিনি সেখান থেকে বেঁচে যান। পরে রুদ্র নারায়ণ তার কৃতকর্মে লজ্জিত হয়ে রাজবাড়িতে না ফিরে তার ছেলে নরোত্তম নারায়ণ রায়কে রাজত্ব বুঝিয়ে দিয়ে কাশি চলে যান।
একসময় রাজপ্রথা বিলুপ্ত হলে চালু হয় জমিদারি প্রথা। এতে রাজা রুদ্র নারায়ণ রায়ের উত্তরসূরিরা পরিণত হন জমিদারে। ফলে রায়েরকাঠির এ ঐতিহাসিক স্থাপনাকে কেউ জমিদার বাড়ি, কেউ রাজবাড়ি বলে থাকেন। অমরেন্দ্র রায় চৌধুরী ছিলেন এ বংশের শেষ জমিদার।
সরেজমিনে দেখা যায়, ভেঙে পড়ছে রাজবাড়ির প্রধান ফটক, প্রাসাদ, কাচারি, অতিথিশালা, নাট্যশালা, জলসাঘর, অন্ধকূপ ও মঠগুলো। নবরত্ন মঠসহ তিনটি মঠের কিছু অংশ ভেঙে পড়েছে। ভবনের গায়ে শ্যাওলা ও লতাপাতা জন্মে জঙ্গলে পরিণত হয়েছে।
দায়িত্বে থাকা মন্দিরের পুরোহিত বলেন, এখানে প্রতিদিন দর্শনার্থী আসেন। পিরোজপুরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে এটি একটি। তাই এই স্থানকে সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করা সরকার এবং স্থানীয় সকলের দায়িত্ব।
স্থানীয় মফিজুল ইসলাম বলেন, “দীর্ঘ ৪০০ বছরের এই পুরাকীর্তি। একসময় এই রাজারা খাজনা তুলতেন এবং দেশ চালাতেন, কালের পরিক্রমায় দেশ ভাগের পরে আজ রায়েরকাঠি বিলীন হওয়ার পথে। আমরা বিভিন্ন সময় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে আবেদন জানিয়েছি যেন স্থাপনাগুলোকে মেরামত করে। তা হলে দেশ ও বিভিন্ন দেশের পর্যটকেরা এই স্থানের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে এবং সমৃদ্ধ হতে পারবে।”
দর্শনার্থী মেহেদী হাসান বলেন, “আমি বাগেরহাট থেকে ঘুরতে আসছি, এখানে এসে খুব ভালো লাগলো এবং ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পেরেছি। তবে আশেপাশে ভালো হোটেল বা থাকার ব্যবস্থা এবং পর্যটন সুবিধা থাকলে এখানে অবস্থান করে পিরোজপুরের অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে পারতাম।”
এলাকাবাসীর দাবি, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এই ঐতিহাসিক রাজবাড়ি ও মঠ সংরক্ষণের উদ্যোগ নিলে একদিকে যেমন স্থানটি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে; অন্যদিকে রায়েরকাঠি হয়ে উঠবে দেশের অন্যতম পর্যটন স্থান।