• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পদ্মার ভাঙন ঝুঁকিতে স্কুলসহ ৩০০ বসতবাড়ি


নয়ন দাস, শরীয়তপুর
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৪, ০৯:৪৭ পিএম
পদ্মার ভাঙন ঝুঁকিতে স্কুলসহ ৩০০ বসতবাড়ি

শরীয়তপুরের জাজিরায় এক সপ্তাহ ধরে ভাঙন দেখা দিয়েছে পদ্মা নদীতে। ভাঙনে এখন পর্যন্ত ভিটেমাটি হারিয়েছেন ২৫০টিরও বেশি পরিবার। এখনো ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে একটি স্কুল ও কয়েকটি মসজিদসহ বিস্তির্ণ চর এলাকার কৃষি জমিসহ আরও প্রায় ৩০০ পরিবার।

শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) সকালে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার পূর্ব নাওডোবা ইউনিয়নের পাইনপাড়া এলাকায় গিয়ে এমন তথ্য পাওয়া যায়।

ভাঙনকবলিত এলাকাবাসীর অভিযোগ, প্রভাবশালী একটি মহল দীর্ঘদিন যাবত পদ্মা নদী থেকে অবৈধভাবে ড্রেজিংয়ের (খননযন্ত্র) মাধ্যমে বালু উত্তোলনের কারণে ভাঙন দেখা দিয়েছে পদ্মা সেতুর অদূরবর্তী পাইনপাড়া এলাকায়।

স্থানীয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, জাজিরা উপজেলার পূর্ব নাওডোবা ইউনিয়নে পদ্মা সেতুর ৫০০ মিটার ভাটিতে পাইনপাড়া এলাকার মাঝি কান্দি ও আহম্মদ মাদবর কান্দি গ্রাম নামে একটি চরের অবস্থান। প্রায় ২৫ বছর আগে বিভিন্ন সময় নদী ভাঙা ও ছিন্নমূল প্রায় ২০ হাজার মানুষ চরটিতে বসতি স্থাপন করে। নদীতে মাছ ধরা ও চরের বিস্তির্ণ জমিতে কৃষি কাজ করেই চরের এসব বাসিন্দারা জীবিকা নির্বাহ করত।

দীর্ঘদিন ধরে রাতের আঁধারে অবৈধভাবে পদ্মা নদী থেকে প্রভাবশালী একটি চক্র ৩০ থেকে ৪০ টি ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করত। স্থানীয়দের বাঁধা ও প্রশাসনের অভিযান পরিচালনা সত্ত্বেও প্রভাবশালী চক্র তা আমলে নেয়নি। বালু উত্তোলনের ফলে মাঝি কান্দি ও আহম্মদ মাদবর কান্দি গ্রামের হাকিম আলী মজুমদারের বাড়ি থেকে মতি মাঝির বাড়ি পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকা ভাঙনের শিকার হয়েছে।

গত এক সপ্তাহে পদ্মার ভাঙনের শিকার হয়ে চরটির কমপক্ষে ২৫০ টি পরিবার তাদের ঘরবাড়ি মঙ্গল মাঝির ঘাট এলাকাসহ অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছেন। এখনো ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে পাইনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মজসিদসহ প্রায় ৩০০ বাড়িঘর। সরকারি হস্তক্ষেপে নদী থেকে অবৈধ ড্রেজিং বন্ধ করে দ্রুত ভাঙন প্রতিরোধ করা না গেলে পদ্মা নদীতে নিচিহ্ন হয়ে যাবে চারদিকে পদ্মা নদী বেষ্টিত পদ্মা সেতুর অদূরবর্তী পাইনপাড়ার মাঝি কান্দি ও আহম্মদ মাদবর কান্দি গ্রাম।

মাঝি কান্দি গ্রামের আনোয়ার মাঝি বলেন, “চরে আমাদের ৩০ বিঘা জমি ছিল। এবারের ভাঙনে ২০ বিঘা জমি নদীতে চলে গেছে। পদ্মার ভাঙন আমার বাড়ির নিকটবর্তী স্থানে চলে আসায় বাড়ি ঘর ভেঙে অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছি। ভাঙনে চরের প্রায় ২৫০ পরিবার বাড়িঘর নিয়ে মঙ্গল মাঝির ঘাটসহ ওই এলাকার সরকারি জমিতে ঘর তুলতেছেন। সেখানে সরকার কতদিন আমাদের থাকতে দেবে তা আমরা জানি না। আমরা চাই সরকার দ্রুত নদী ভাঙন রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করুক।”

ইদ্রিস মজুমদার নামের একজন বলেন, “ভাঙনে জায়গা-জমি, ভিটেবাড়ি যা ছিল, সব পদ্মায় নিয়ে গেছে। আমরা এখন সর্বহারা হয়ে গেছি। এখন গৃহস্থ্যও নেই যে কাজ-কর্ম করে আয় করব। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ আমরা। ছেলে-মেয়ে নিয়ে ডাল-ভাত খাওয়ার উপায়ও আমাদের এখন নেই।”

শহরবানু নামের এক বৃদ্ধা বলেন, “নদী ভাঙতে ভাঙতে এখন আমরা পথের ফকির হয়ে গেছি। এত ভাঙন এখন আর শরীরে সয় না। বুড়ো মানুষগুলোর শরীরে শক্তি নাই। পায়ের তলায় মাটি নেই, কই যাব, কী করব? চুলা নাই, কোথায় রান্না করব? কিছুরই ঠিক ঠিকানা নাই। আল্লায় জানে আর আমরা জানি, কী কষ্ট করছি। আর কেউ বুঝবে না।”

শহরবানু নামে এক বৃদ্ধা বলেন, “নদী ভাঙতে ভাঙতে ফকির হয়ে গেছি। এক জীবনে কতবার ভাঙন সহ্য করা যায়। কষ্ট আমাদের মতো বুড়ো মানুষদের। শরীরে শক্তি নাই, পায়ের তলায় মাটি নাই। ঘরবাড়ি ভেঙে নিয়ে যাচ্ছি সরকারি জায়গায়। কোথায় রান্না করব? কী খাব? কী করব? কোনো কিছুরই ঠিক ঠিকানা নাই।”

ফজলু মাঝি নামে এক বৃদ্ধ বলেন, “গ্রামটিতে প্রায় ৫০০ পরিবারের বসতি ছিল। সব দিক থেকেই পদ্মা ভাঙতেছে। ২৫০টি বাড়ি পদ্মার গর্ভে হারিয়ে গেছে। এখন আমার থাকার মতো কোনো জায়গা নেই। বাড়িঘর ভেঙে সরকারি জায়গায় চলে যাচ্ছি। সরকার থাকতে দিলে থাকতে পারব, অন্যথায় পথে পথে থাকতে হবে। সরকার যদি বালু কাটা বন্ধ করত, তবে ভাঙন থামত।”

শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপসহকারী প্রকৌশলী দেওয়ান রকিবুল হাসান সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “পাইনপাড়া এলাকাটি পদ্মার মধ্যবর্তী একটি চর। যখনই পাইনপাড়ায় ভাঙন দেখা দিয়েছে, তখনই আমরা বালুভর্তি জিওব্যাগ ডাম্পিং ও প্লেসিং করে ভাঙনরোধে কাজ করেছি। পাইনপাড়া এলাকাটিতে ভাঙনরোধ করতে আমরা স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করব। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা সাপেক্ষে আমরা পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”

বিষয়টি নিয়ে শরীয়তপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সাইফুদ্দিন গিয়াস সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “পদ্মা নদী থেকে বালু উত্তোলনের জন্য কাউকে লাইসেন্স প্রদান করা হয়নি। এরপরও একটি কুচক্রী মহল রাতের আঁধারে নদী থেকে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করত। বালু উত্তোলনকারী মহলের বিরুদ্ধে জাজিরা উপজেলা প্রশাসন একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করে তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলাও রুজু করেছে। পদ্মার ভাঙনরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড জিওব্যাগ ফেলাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।”

Link copied!