সুমা আক্তার (ছদ্মনাম)। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। বাড়ি দিনাজপুরের এক অজপাড়া গ্রামে। স্কুলে থাকতে সহপাঠীর সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কয়েক বছর পর তারা সিদ্ধান্ত নিলেন পালিয়ে বিয়ে করবেন। ঢাকায় গিয়ে পোশাক কারখানায় চাকরি করবেন।
‘কিন্তু প্রেমিকের মনে এত খারাপ চিন্তা ছিল, কে জানত!’—আক্ষেপের সুরে বলছিলেন সুমা।
বাড়ি থেকে বের হন তারা। প্রেমিক সুমাকে টাঙ্গাইল শহরের কান্দাপাড়ায় নিয়ে যান। সেখানকার যৌনল্লিতে ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে তাকে বিক্রি করে দেন। এরপর সুমা এখানকার এক সর্দারনির কাছে সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় থাকেন। সর্দারনির বিয়ে হয়ে গেলে তিনিও এখান থেকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পারেননি। মনের কষ্ট মনে রেখে নিজেই একটি কক্ষ ভাড়া করে যৌনপল্লিতে বসবাস করছেন। প্রতি মাসে আয় হয় প্রায় ২০ হাজার টাকা। ঘর ভাড়া, খাবারসহ অন্যান্য খরচ শেষে পরিবারকেও কিছু টাকা পাঠান সুমা।
‘এই জগৎ থেকে কি বেরিয়ে আসতে মন চায়?’ সুমার উত্তর, “বেরিয়ে তো আসতেই চাই। এরপর কী করব? আমাদের কে বিয়ে করবে? সরকারিভাবে কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিলে এ পথ ছাড়ব। মৃত্যুর পর আমাদের কবরের জায়গা হয় না। এখানে আর থাকতে চাই না।”
শুধু সুমা আক্তার নন, তার মতো এ যৌনল্লির প্রত্যেকের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন গল্প। চাকরি কিংবা বিয়ে এমন প্রলোভনে পড়ে তাদের অনেকে নিজের অনিচ্ছায় পা বাড়িয়েছেন এ অন্ধকার পথে। অনেকে ফিরতে চান স্বাভাবিক জীবনে। অনেকে জানেন না কী করবেন এ পথ ছেড়ে। এ যেন অন্তহীন এক গোলকধাঁধা।
১৮১৮ সালে টাঙ্গাইল পৌর শহরের কান্দাপাড়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ যৌনপল্লি। ৩০২ শতাংশ জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত দুই শ বছরের বেশি সময় ধরে চলছে এ যৌনপল্লি। বর্তমানে এখানকার ৫৯টি বাড়িতে ৬ শতাধিক নারী যৌন পেশায় জড়িত। ২০১৪ সালে স্থানীয় নেতাকর্মীরা ভেঙে দেন। পরে যৌনকর্মী ও জমির মালিকরা উচ্চ আদালতে আবেদন করে। আদালত তাদের পক্ষে রায় দেন। পরে বাড়িগুলো তারা ধীরে ধীরে নির্মাণ করেন।
বছরে নানা কারণে যৌনপল্লিতে চার থেকে পাঁচজন আত্মহত্যা করেন। যাদের অধিকাংশের বয়স ২৫-৩০-এর মধ্যে। তারা অধিকাংশই নেশাগ্রস্ত। গত ঈদে বাড়ি যাবেন বলে এক যৌনকর্মী এখান থেকে বেরিয়ে যান; কিন্তু আর আসেননি।
সরেজমিনে দেখা যায়, চারদিকে দেয়াল দেওয়া পল্লির ভেতরে সারিবদ্ধ আধাপাকা ঘর। কয়েকটি পয়েন্টে প্রবেশপথ। ভেতরে আছে সরু গলি, ছোট মুদিদোকান, চায়ের দোকান ও খাবার হোটেল। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বা বসে অনেক নারী পান খাচ্ছে, ধূমপান করছে। অনেকে ভেতরে যার যার রুমের সামনে বসে সাজগোজ করছে, কেউ কেউ খদ্দের আকৃষ্ট করতে দাঁড়িয়ে আছে। পল্লির ভেতরে মাদক কারবারও চলে পুরোদমে।
জানা যায়, এ যৌনপল্লিতে নারী পাচার, বিক্রি ও নির্যাতনের সংখ্যা কমলেও বেড়েছে এখানকার নারীদের আত্মহত্যার প্রবণতা। এদিকে বয়স্ক যৌনকর্মীর সংখ্যা বাড়ছে যৌনপল্লিতে। এদের অধিকাংশই পল্লিতে মুদিদোকানসহ বিভিন্ন ব্যবসা, মাদক বিক্রি ও দালালের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
একটি কক্ষে ঢুকে দেখা যায়, অল্প আয়তনের ঘরটিতে আছে খাট, টিভি, সাউন্ডবক্স, ফ্রিজ, চেয়ার, ড্রেসিং টেবিল, আলমারিসহ নানা আসবাবপত্র রয়েছে।
কথা হয় কবিতা আক্তারের (ছদ্মনাম) সঙ্গে। তার বয়স ২৮ বছর। তিনি বলেন, “দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় আমি। সংসারে অভাব থাকায় সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় এক দিনমজুরের সঙ্গে বিয়ে হয়। আমার স্বামী ৫০ হাজার টাকা আনতে বলে বাবার বাড়ি থেকে। আমি রাজি না হওয়ায় আমাকে নির্যাতন করত। বাবা-মার সিদ্ধান্তে তাকে ডিভোর্স দিই। এরপর বাবার বাড়িতে জায়গা হয়। তারপর একজনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। সে-ও আমার সবকিছু লুটে নেয়। পরে পাশের এলাকার এক ভাই আমাকে ঢাকায় চাকরি দেওয়ার কথা বলেন। তার সঙ্গে ঢাকায় যাওয়ার পথে মানিকগঞ্জের দৌলতদিয়ায় আমাকে রেখে পালিয়ে যায়। তারপর সেখানকার একজনের জিম্মায় এ পেশায় যুক্ত হতে বাধ্য হই।”
তিনি বলেন, “প্রথম কয়েক মাস সারা রাত জাগতে হয়েছে। বিভিন্ন ওষুধ খেতে হয়েছে। এরপর শরীর শুকিয়ে যায়। পরে একজন মোটা হওয়ার ওষুধ দেয়। দৌলতদিয়ায় প্রায় চার বছর থাকার পর সেখান থেকে টাঙ্গাইলে চলে আসি। এখানে ভালোই আছি। নিজের ঘর, স্বাধীনতা সবই আছে। বাড়ির কেউ জানে না আমি এ কাজ করি। সবাই জানে গার্মেন্টসে কাজ করি। মাসে মাসে বাড়িতে টাকা পাঠাই।”
৪৫ বছরের বিন্দু বেগম (ছদ্মনাম)। তিনি এখন আর এ পেশায় নেই। এখানেই একটি মুদিদোকান চালান। বিন্দু বলেন, “সংসারে অভাবের কারণে একটি খাবারের হোটেলে কাজ করতাম। সেখানকার এক কর্মচারী বিয়ের আশ্বাস দেয়। তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক হয়। হঠাৎ একদিন তার আর খোঁজ পাই না। মনের কষ্টে বাধ্য হয়ে টাঙ্গাইল যৌনপল্লিতে আসি। এখানে আসার পর একটি মেয়েসন্তানের জন্ম দেই। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। কিন্তু পরিবারের কেউ জানে না আমি এ অন্ধকার পথে আছি। সরকার কোনো কর্মসংস্থানের জায়গা করে দিলে এখান থেকে বেরিয়ে যাব।”
রুপালী (৩৫) (ছদ্মনাম) যৌনপল্লিতে কাজ করেন ১৫ বছর ধরে। তিনি বলেন, “আমার বয়স যখন ১৫ তখন আমার গ্রামের এক লোক চাকরি দেওয়ার কথা বলে টাঙ্গাইলের যৌনপল্লিতে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেয়। তারপর সর্দারনির সঙ্গে থাকতাম। দৌলতদিয়া যৌনপল্লিতে কিছুদিন থাকার পর আবার টাঙ্গাইল এসে নিজে একটা রুম ভাড়া নিই। এভাবেই চলে যায় ১০ বছর। চার বছর ধরে যৌন পেশার পাশাপাশি চা-পানের দোকান দিয়েছি। ঘরভাড়া দিতে হয় প্রতিদিন ৩০০ টাকা করে। দোকানে প্রতিদিন ২-৩ হাজার টাকার চা-পান বিক্রি হয়। সমস্ত খরচ করে যা থাকে কিছু কিছু জমা করছি। এখানে আর বেশিদিন থাকব না। বাড়ি থেকেও চলে যেতে বলছে। দুয়েক বছর পর বাড়ি চলে যাব; ওখানে কিছু একটা করে খাব।”
যৌনকর্মীরা বলেন, “দালালরা অন্যায়ভাবে ক্ষতি করার চেষ্টা করে। তাদের সঙ্গে সর্দারনিরাও জড়িত। কেউ বেশি উপার্জন করলেও মাদক অথবা নারী পাচারকারী বলে পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশও তাদের কথামতো এসে আমাদের আটক করে। পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে অনেক টাকা দিতে হয়। বিভিন্ন খাতে টাকার ভাগ দিতে হয়। অনেক নিরীহ মেয়ে এখানে এসে প্রতারণার ফাঁদে পড়ে।”
যৌনপল্লির নেত্রী মনোয়ারা বেগম বলেন, “আমাদের এখানে কোনো খদ্দের আটকে রেখে টাকা নেওয়া হয় না। তাদের কোনো হয়রানিও করা হয় না।”
জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক শাহ আলম বলেন, “যৌনপল্লীর বাসিন্দাদের কোনো তালিকা কিংবা তাদের জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। নারীমুক্তি নামে একটি সংগঠন আছে। তারা ওখানে সঞ্চয় করে, ওখান থেকে তারা ঋণ পান। আলাদা তাদের জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। তবে যদি কেউ বয়স্কভাতার উপযোগী হন, তাদের ভাতার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।”
টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) শরফুদ্দীন বলেন, “টাঙ্গাইলের যৌনপল্লিতে বিট পুলিশিং কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। যৌনপল্লিসহ জেলায় মাদকের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলমান রয়েছে। পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।”