শেরপুরের ঐতিহাসিক জগৎপুর গণহত্যা দিবস আজ। ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল ঝিনাইগাতী উপজেলার ধানশাইল ইউনিয়নের জগৎপুর গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে অন্তত ৪২ জন গ্রামবাসীকে। আহত হন অর্ধশতাধিক মানুষ। দুই শ-রও বেশি বাড়ি-ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে গেলেও ওই গ্রামে শহীদদের স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখতে নির্মিত হয়নি কোনো স্মৃতিফলক। করা হয়নি শহীদদের নামের তালিকা। এখনো অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে আছে শহীদদের গণকবর।
শেরপুর জেলা শহর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে ঝিনাইগাতী উপজেলার ধানশাইল ইউনিয়নে জগৎপুর গ্রামের অবস্থান। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি বাহিনী আর তাদের দেশীয় দোসররা গ্রামটির তিন দিক ঘিরে ফেললে গ্রামের মানুষ প্রাণ বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন পাশের রাঙ্গুনিয়া বিলে। সেদিনের বর্বোরোচিত হামলায় ৪২ জনের প্রাণ গেলেও ভয়াল স্মৃতি বুকে নিয়ে আজও বেঁচে আছেন অনেকেই।
সেদিনের সেই ভয়াল স্মৃতিচারণ করে বেঁচে থাকা গ্রামবাসী সোবহান মিয়া, হোসেন আলী, লক্ষণ দাশ ও লক্ষ্মী রানী দেব জানান, সেদিন ছিল বাংলা ১৬ বৈশাখ ৩০ এপ্রিল শুক্রবার। সকাল ৮টার দিকে জগৎপুরের সামনের শংকরঘোষ গ্রামের স্থানীয় রাজাকার মজিবর, বেলায়েত, নজর ও কালামের সহযোগিতায় পাকিস্তানি বাহিনী জগৎপুর এলাকা তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। তারা তিনটি দলে বাগ হয়ে গ্রামের তিন দিকে অবস্থান নিয়ে নির্বিচারে গুলি করতে থাকে। গ্রামবাসী কোনো কিছু না বুঝেই জীবন বাঁচাতে গ্রামের পেছনের দিকের রাঙ্গুনিয়া বিলের দিকে দৌড়ে পালাতে থাকেন। কিন্তু বিলের মাঝখানে পানি থাকায় কেউ সাঁতরে, আবার কেউ বিলের দুপাড় ঘেঁষে পালিয়ে যান। ওই সময় শুকনো জায়গা দিয়ে পালাতে গিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শহীদ হন ৪২ জন গ্রামবাসী।
শুধু গুলি করে গ্রামবাসীকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি পাকিস্তানি সেনারা। তারা জনমানুষ শূন্য গ্রামের বাড়ি-ঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। ওই ঘটনার পর অনেকেই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যান। আবার অনেকেই নাড়ির টানে পড়ে থাকেন গ্রামেই।
জগৎপুরের কৃষক আব্দুস সামাদের ছোট ভাই আলফাজ ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি পার্শ্ববর্তী একটি ব্রিজ ভাঙার জন্য গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছলে তার মায়ের অসুস্থতার খবর শুনে গ্রামে ছুটে যান। ওইসময় তার সঙ্গে ছিলেন আরও এক মুক্তিযোদ্ধা। দেশ স্বাধীনের মাসখানেক আগে স্থানীয় রাজাকাররা তার ভাই ও ওই মুক্তিযোদ্ধাকে ডেকে নিয়ে গেলেও আজও তাদের কোন খবর পাওয়া যায়নি।
স্থানীয় রাখাল সূত্রধর বলেন, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পার হয়ে গেলেও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে আজও শহীদদের নাম ফলক ও গণকবরের স্মৃতিচিহ্ন রক্ষায় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সেইসাথে দেশের বিভিন্ন স্থানের শহীদদের তালিকা করা হলেও জগৎপুরের শহীদদের তালিকাও নেই কারও কাছে। সেখানে মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম জাদুঘর, শেরপুর সদর ইউনিটের উদ্যোগে যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের ঘোষণাসহ একটি সাইনবোর্ড বছর তিনেক আগে দেয়া হলেও সেটিও বর্তমানে উল্টে পড়ে আছে।
সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, ওই এলাকায় গণকবরের কোনো চিহ্নই বোঝার উপায় নেই। স্থানীয় শহীদ পরিবারের স্বজনরা সরকারের কাছে দ্রুত গণকবরটি সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম হিরু বলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শেরপুর অঞ্চলের গণহত্যার ইতিহাসে জগৎপুর আজও এক দগদগে ক্ষত। জগৎপুর এলাকায় সংঘটিত গণহত্যায় শহীদদের তালিকা পর্যন্ত হয়নি। এখানকার কবরগুলোর চিহ্নও মুছে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।