আগামী ২১ জুন রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক) নির্বাচন। ২৫ মে মেয়র-কাউন্সিলর প্রার্থীদের তথ্য যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। এবারের নির্বাচনে মেয়র পদে চারজনেরই মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। আসন্ন রাসিক নির্বাচনে বিএনপি থেকে কেউ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাকের পার্টির প্রার্থীর মধ্যেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।
এই চার প্রার্থীর মধ্যে সবচেয়ে সম্পদশালী আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী ও সদ্য সাবেক মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। তার বার্ষিক আয় ২ কোটি ৯৮ লাখ ১০ হাজার এবং স্ত্রীর বার্ষিক আয় দেখানো হয়েছে ২ কোটি ১০ লাখ কোটি টাকা। তবে লিটনের দাখিলকৃত হলফনামায় নিজের পেশা আইনজীবী ও রাজশাহী বার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য বলা হলেও মূলত তার ও স্ত্রীর উপার্জনের মূল আয়ের উৎস মৎস্য চাষ। লিটন ও তার স্ত্রীর মাছ চাষ করে বছরে আয় হয় ৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকা।
এদিকে গেল ২০১৮ সালের ৩০ জুলাইয়ের সিটি নির্বাচনের সময় লিটনের বার্ষিক আয় ছিল ৪২ লাখ ৪৫ হাজার ২৮৮ টাকা। এই হিসাবে গত পাঁচ বছরে মেয়র লিটনের বার্ষিক আয় বেড়েছে ২ কোটি ৫৫ লাখ ৬৪ হাজার ৭১২ টাকা। হিসাব অনুযায়ী ৫ বছরে লিটনের বার্ষিক আয় বেড়েছে ৭ দশমিক শূন্য ৩ গুণ।
নির্বাচনে মেয়র প্রার্থীদের দাখিল করা হলফনামায় দেখা গেছে, শিক্ষাগত যোগ্যতায় এগিয়ে আছেন জাকের পার্টির প্রার্থী মো. লতিফ আনোয়ার, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী হাফেজ মাওলানা মো. মুরশিদ আলম খান এবং আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। এদের মধ্যে লতিফের শিক্ষাগত যোগ্যতা এলএলএম; মুরশিদ আলম কামিল পাস এবং লিটন বিএ (এলএলবি) ডিগ্রিধারী। জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো. সাইফুল ইসলাম স্বপন ‘স্বাক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন’।
নির্বাচন কমিশনে (ইসি) মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় প্রার্থীরা রাসিক নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে তাদের হলফনামায় সম্পদের হিসাব দিয়েছেন। এতে প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্যের পাশাপাশি তাদের আয়, আয়ের উৎস, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ, শিক্ষাগত যোগ্যতা, মামলা, দেনাসহ বেশ কিছু তথ্য দিয়েছেন।
হলফনামা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন বিএ (সম্মান) পাস। তিনি পেশায় আইনজীবী। তার বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা নেই। তার বার্ষিক আয় ২ কোটি ৯৮ লাখ ১০ হাজার। এর মধ্যে মাছ চাষ করে বছরে আয় ২ কোটি ৪২ লাখ, বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্ট/ দোকান বা অন্যান্য ভাড়া থেকে ৩৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা, কৃষি খাত থেকে ২ লাখ ৩০ হাজার এবং মেয়র হিসেবে সম্মানী ভাতা বাবদ বছরে লিটনের আয় ১৬ লাখ ১০ হাজার টাকা। মাছ চাষ করেন লিটনের স্ত্রীও। এ থেকে তার স্ত্রীর বার্ষিক আয় ১ কোটি ৪১ লাখ এবং অন্যান্য ব্যবসায় আয় ১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। লিটনের অস্থাবর সম্পদের মধ্যে নগদ আছে ৭ লাখ ২ হাজার ২৩৭ টাকা। আর স্ত্রীর নগদ অর্থ রয়েছে ১৮ লাখ ৪৭ হাজার ১৩০ টাকা। লিটনের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা রয়েছে ২ কোটি ৮৪ লাখ ৯১ হাজার ৮০০ টাকা এবং স্ত্রীর জমা রয়েছে ১ কোটি ৭৮ লাখ ৭৬ হাজার ৮৭০ টাকা। এর বাইরে অস্থাবর সম্পদের মধ্যে লিটনের রয়েছে ১৫ ভরি স্বর্ণালংকার, উপহার হিসেবে স্ত্রীর নামে রয়েছে ৫০ ভরি স্বর্ণালংকার। এ ছাড়া লিটনের নির্ভরশীল ব্যক্তির নামে ২১ ভরি স্বর্ণালংকার রয়েছে। নিজের নামে ২৫ লাখ টাকার ইলেকট্রনিক সামগ্রী ও স্ত্রীর নামে রয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকার ইলেকট্রনিক সামগ্রী। লিটনের ৭ লাখ টাকার এবং স্ত্রীর ২ লাখ ১০ হাজার টাকা সমমূল্যের আসবাবপত্র রয়েছে।
লিটনের স্থাবর সম্পদের মধ্যে ৪ দশমিক ৬৩ একর এবং স্ত্রীর নামে ১ দশমিক ৭৭০৫ একর কৃষি জমি রয়েছে। নিজের নামে একটি তিনতলা এবং লিটনের স্ত্রীর নামে দুইতলা একটি পুরাতন বাড়ি রয়েছে। স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে লিটনের আরেও রয়েছে ৭০ লাখ ১২ হাজার ১৯০ টাকা সমমূল্যের একটি মাছের খামার, আর স্ত্রীর রয়েছে ৭৯ লাখ ৩৫ হাজার টাকা সমমূল্যের মৎস্য খামার। লিটনের রয়েছে দায়দেনাও। গাড়ি ক্রয় বাবদ একটি ব্যাংকে ২০ লাখ ৭৯ লাখ ৩৭ টাকার ঋণ রয়েছে।
হলফনামায় দেওয়া সম্পদের ব্যাপারে লিটন বলেন, “আমার যে সম্পদ তার সবই বৈধ উপায়ে অর্জিত এবং সম্পদের আয়কর যথাযথভাবে পরিশোধ করেছি।”
জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো. সাইফুল ইসলাম স্বপন পেশায় ব্যবসায়ী। তার বার্ষিক আয় ৩০ লাখ টাকা। ব্যবসায়ী স্বপনের অস্থাবর সম্পদের মধ্যে তার নগদ অর্থ রয়েছে ৩ লাখ টাকা। ব্যাংকে জমা রয়েছে ৫০ হাজার টাকা। তার ১০ ভরি স্বর্ণ এবং ৮০ হাজার টাকার ইলেকট্রনিক সামগ্রী ও আসবাব রয়েছে। সিটি নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মেয়র প্রার্থী হাফেজ মাওলানা মুরশিদ আলী খান। কামিল (মাস্টার্স) পাসের এই প্রার্থী পেশ টিউটর/ধর্মীয় আলোচক। মুরশিদের বার্ষিক আয় ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা। অস্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে নগদ ১২ টাকা, একটি মোটরসাইকেল, ১০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার। ইলেকট্রনিক সামগ্রীর মধ্যে ফ্রিজ, ফ্যান, ল্যাপটপ ইত্যাদি এবং আসবাবপত্রের মধ্যে রয়েছে খাট, আলমারি ইত্যাদি।
আরেক মেয়র প্রার্থী মো. লতিফ আনোয়ার। জাকের পার্টির এই প্রার্থী এলএলএম পাস। আইন পেশার এই প্রার্থীর বার্ষিক আয় ৩ লাখ টাকা। অস্থাবর সম্পদের মধ্যে তার নগদ অর্থ রয়েছে ১ লাখ টাকা। ব্যাংকে জমা রয়েছে ২ হাজার টাকা। তার ৫০ হাজার টাকার ইলেকট্রনিক সামগ্রী ও আসবাব রয়েছে।
প্রার্থীদের হলফনামার বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রাজশাহীর সভাপতি আহমদ সফিউদ্দিন বলেন, “কার কতটুকু সম্পত্তি রয়েছে সেটি বড় বিষয় নয়। মূল কথা হচ্ছে, একসময় হলফনামায় বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী, নাগরিক গ্রুপ, সিভিল সোসাইটি এবং সচেতন নাগরিকদের মতামত দাখিল করা হতো। সেটি করা হচ্ছে না। আজকে বৈধ কিংবা অবৈধ আয়ের সীমা-পরিসীমা যাচাই করার যে মেশিনারি বা প্রতিষ্ঠানগুলো কি সচল আছে? এটি বড় প্রশ্ন। কাজেই হলফনামায় প্রার্থীদের বিভিন্ন তথ্য দেওয়া-না দেওয়ার বিষয়টি অনেকটা অর্থহীন হয়ে পড়েছে।”