কুমিল্লার সরকারি গ্রন্থাগারে মানোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে পাঠক সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু জনবল সংকটের কারণে সময়মতো মিলছে না সব সেবা। গ্রন্থাগারটিতে ৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে মাত্র দুজন কাজ করেন। তারাই কম্পিউটার অপারেটরের কাজ করেন। তারাই খুলছেন দরজা-জানালা। আবার তারাই পাঠকদের বই খুঁজে দিচ্ছেন।
জানা যায়, এ গ্রন্থাগারে ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দিনে ২০ জন পাঠকও আসতেন না। নারী পাঠকের কথা তো ভাবাই যেত না। পরিচিতির অভাবে অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল। ২০১৫ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে গ্রন্থাগারের মানোন্নয়নে কাজ শুরু হয়। সেই সঙ্গে শুরু হয় প্রচার-প্রচারণা। বাড়ানো হয় বইয়ের সংখ্যা। পাঠকদের আসন সংখ্যাও বৃদ্ধি করা হয়। পাঠকদের বই, ব্যাগ, খাবার রাখার জন্য তৈরি করা হয় প্রয়োজনীয় আসবাব। এরপরই গ্রন্থাগারটি পায় নতুন রূপ। দিন বদলের সঙ্গে বাড়তে থাকে পাঠক সংখ্যা।
বর্তমানে গ্রন্থাগারে ১৫০ জনে পাঠকের বসার জায়গা আছে। এর মধ্যে ২২টি আসন নারী পাঠকদের জন্য সংরক্ষিত। এখন প্রতিদিন তিন শতাধিক পাঠক আসেন। এর মধ্যে নারী পাঠকও রয়েছেন।
বর্তমানে গ্রন্থাগারে ৪৬ হাজারের বেশি বই আছে। এর মধ্যে বাংলা ভাষার বই আছে ৪০ হাজার ৮৪৭টি। আরবি ভাষার বই আছে ২০০টি। ইংরেজি ভাষার বই ৫ হাজার ৫৯৪টি। অন্যান্য ভাষার বই আছে ৪৪টি। এসব বইয়ের জন্য রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন কর্নার। জবস কর্নারে আছে প্রায় ২০০টি বই, ইতিহাস কর্নারে আছে ৯ হাজার ৫০০ বই, নজরুল কর্নারে আছে ১ হাজার ১০০টি, রবীন্দ্র কর্নারে আছে ১ হাজার ২০০টি, বঙ্গবন্ধু কর্নারে আছে ২ হাজার ২০০টি বই। মুক্তিযুদ্ধ কর্নারে আছে ১ হাজার ৬০০টি বই। এ ছাড়া ধর্মীয়, আন্তর্জাতিক, ব্যক্তি-সম্পর্কিত, আইন-সম্পর্কিত, কুমিল্লা জেলা সম্পর্কিতসহ অন্যান্য বই আছে ২২ হাজারের বেশি।
এখানকার বেশির ভাগ পাঠক তরুণ। সবাই চাকরিপ্রত্যাশী। যে কারণে সবচেয়ে বেশি পাঠ হয় জবস কর্নারের বই। এ ছাড়া ইতিহাস কর্নার, নজরুল কর্নার, রবীন্দ্র কর্নার, ধর্মীয় কর্নার, বঙ্গবন্ধু কর্নার, মুক্তিযুদ্ধ কর্নার ও আন্তর্জাতিক কর্নারের বইয়ের পাঠক চাহিদা ভালো।
গণগ্রন্থাগারের সাধারণ পাঠক হতে সদস্য পদের প্রয়োজন নেই। কিন্তু গণগ্রন্থাগারের বই বাসাবাড়িতে নিয়ে পড়তে চাইলে সদস্য হতে হবে। প্রথম দিকে সদস্য হওয়ার নিয়ম না থাকলেও বর্তমানে সদস্যের বাইরে কাউকে বাড়িতে বই নিতে দেওয়া হয় না। সদস্য হতে পূরণ করতে হয় একটি সদস্য ফরম। এরপর তিনটি শ্রেণিতে পাঠককে ভাগ করে জামানত নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রথম শ্রেণিতে শিশুরা, দ্বিতীয় শ্রেণিতে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী এবং তৃতীয় শ্রেণিতে সাধারণ পাঠক। শিশুদের জন্মসনদ ও বইয়ের মূল্যমান অনুযায়ী ২০০ টাকা জামানত জমা রাখতে হয়। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ৩০০ টাকা জামানত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচয়পত্র ও জন্মসনদ বা জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দিতে হয়। সাধারণ পাঠকের জন্য ৫০০ টাকা জামানত, জন্মসনদ বা জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দিতে হয়। সদস্য হলেই কেবল নিয়ম মেনে বই বাড়িতে নেওয়া যায়। এ ছাড়া কেউ বই নিতে পারেন না। যদি কেউ সদস্য পদ বাতিল করতে চান তাহলে বই ফেরত দিয়ে জামানতের টাকা নিতে পারবেন। বর্তমানে সদস্য সংখ্যা ১৭০ জন।
গণগ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে ১৯৯০ সাল থেকে একাধিক পত্রিকার পুরোনো সংখ্যা। যা স্থানীয় ও দূরদূরান্তের পাঠকদের এই পাঠাগারে টেনে আনে।
পাঠক বৃদ্ধিতে গণগ্রন্থাগারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন স্কুল-কলেজের জাতীয় দিবসে আয়োজন করা হয় সেমিনার ও অস্থায়ী বুক স্টল। এতে গ্রন্থাগারের প্রচার হয়। আয়োজন করা হয় মাসিক, ত্রৈমাসিক ও বার্ষিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতা। ফলে এটি নিয়ে পাঠক সমাজে আলোচনা সৃষ্টি হয়। গ্রুপ স্টাডির জন্য পাঠাগারের সামনে রয়েছে চার আসনবিশিষ্ট একটি বসার স্থান।
শিশু শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে ২০১৯ সালে শুরু করা হয় টয় ব্রিকস। এছাড়া রচনা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। নারী পাঠকদের জন্য রয়েছে নামাজের ব্যবস্থা। দুপুরে খাবার খাওয়ার জন্য আছে আলাদা কর্নার। রয়েছে দৈনিক ও স্থানীয় পত্রিকা পড়ার সুযোগ। গণগ্রন্থাগারের হেল্প লাইন নম্বরে কল দিলেই বেজে উঠে একটি ওয়েলকামটোন। যেখানে গণগ্রন্থাগারের সেবাসমূহ বর্ণনা করা হয়। এতে ভোগান্তি ছাড়াই সেবা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পান পাঠকরা।
১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠার পর কোনো বছর দুই আবার কোনো বছর তিনজনের বেশি জনবল এই গ্রন্থাগারে ছিল না। যে কারণে শুরু থেকেই রয়েছে সংকট। তবে এর বাইরেও রয়েছে নানা সংকট। নেই পর্যাপ্ত আসন। এতে পাঠকদের এসে ফিরে যেতে হয়। আলোর স্বল্পতায় অনেক পাঠক এসে ফিরে যান। এত পাঠকের জন্য দুটি মাত্র টয়লেট থাকায় সমস্যায় পড়তে হয়। খাবার খাওয়ার একটি কর্নার থাকলেও এটি সম্পূর্ণ অস্থায়ী ও খোলামেলা।
গ্রন্থাগারের নিয়মিত পাঠক আবদুল কাদের বলেন, “আমি সব সময় এখানে আসি। নিরিবিলি পরিবেশ, তাই ভালোভাবে পড়াশোনা করা যায়। এখানকার বেশির ভাগ পাঠক চাকরিপ্রত্যাশী। তারা এখানে চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার পড়াশোনা করেন। তবে এখানে আমাদের বই খুঁজে দেওয়ার লোক নেই। তাই বই খুঁজতে অনেক সময় লাগে। এছাড়া নেই কোনো গার্ড। অনেক সময় আমাদের এসে দরজা খুলতে হয়। মাত্র দুই জন লোককে দেখি সারাক্ষণ কাজ করেন। জনবল সংকট দূর হলে সুবিধা হতো।”
গ্রন্থাগারের ক্যাটালগার মো. ফারুক মিয়া বলেন, “সপ্তাহে শনিবার থেকে বুধবার সরকারি নিয়মানুযায়ী সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে গণগ্রন্থাগার। লোকবল সংকটের কারণে দিনে যে পরিমাণ পাঠকের চাপ থাকে তা সামলাতে একরকম হিমশিম খেতে হয়। লোকবল ছাড়া আমরা একরকম বেসামাল হয়ে যাই। সব কাজ আমাদেরই করতে হয়।”
কুমিল্লা সরকারি গণগ্রন্থাগারের সহকারী গ্রন্থাগারিক মো. নাফিস সাদিক শিশির বলেন, “কুমিল্লার মানুষ বইপ্রেমিক। প্রথম দিকে পাঠক কম ছিল। বর্তমানে পাঠকের স্রোত। এখানে বেশির ভাগ পাঠক তরুণ। তারা বেশিরভাগই চাকরির পড়াশোনা করতে আসেন। এই ধারাটা অব্যাহত রাখতে চাই। আমাদের পরিকল্পনা আছে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করবো, মানুষ যেন গ্রন্থাগার সম্পর্কে জানতে পারেন। তবে আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা জনবল সংকট। এত বড় গ্রন্থাগারে ৯ জনের কাজ আমাদের ২ জনকে করতে হয়।”
কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, “পাঠাগারের উন্নয়ন ও পাঠক বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়নের কাজ চলছে।”