• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আশ্রয় নেওয়া বাড়ির লোকদের যা বলেছিলেন রহিমা


হারুন-অর-রশিদ, ফরিদপুর
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২২, ০৮:৫৯ পিএম
আশ্রয় নেওয়া বাড়ির লোকদের যা বলেছিলেন রহিমা

ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামে কুদ্দুস মোল্লার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন আলোচিত রহিমা বেগম (৫২)।

জানা গেছে, কুদ্দুস মোল্লা (৭০) খুলনার সোনালী জুট মিলে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। কর্ম সূত্রে সেখানে দীর্ঘদিন রহিমা বেগমের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন তিনি। বছর দশেক আগে পাটকল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর কুদ্দুস বোয়ালমারীর সৈয়দপুরে নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন। সেই বাড়ি থেকেই শনিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) রাত সাড়ে ১০টার দিকে খুলনা মহানগর পুলিশ রহিমা বেগমকে উদ্ধার করেন।

উদ্ধারের আগে বাড়ির লোকজনকে রহিমা বলেছিলেন, ছেলে–মেয়েদের ওপর রাগ করে ঘর ছেড়েছেন তিনি। তিনি আর বাড়ি ফিরতে চান না। প্রতিবেশীদের সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধের কথাও বলেছিলেন।

গত ২৭ আগস্ট রাত ১০টার দিকে খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা উত্তর বণিকপাড়া এলাকার বাসার উঠানের নলকূপে পানি আনতে যান রহিমা বেগম। এরপর থেকেই নিখোঁজ ছিলেন তিনি। পরদিন তার মেয়ে আদুরী আক্তার বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে থানায় অপহরণ মামলা করেন। এ মামলায় ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মায়ের সন্ধান চেয়ে মানববন্ধনও করেছেন আদুরী।

এদিকে, কুদ্দুস মোল্লার বাড়ির লোকজন ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ১৭ সেপ্টেম্বর বিকালে বাসে করে সৈয়দপুর বাসস্ট্যান্ড নামেন রহিমা। তিনি এসে ওই বাজারের মুদি দোকানদার ইউনুস বিশ্বাসের কাছে মোতালেব মুসল্লির (কুদ্দুস মোল্লার বাবা) বাড়ি কোথায় জানতে চান। ইউনুস বিশ্বাস তার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন,বরিশাল থেকে এসেছেন। তিনি কুদ্দুস মোল্লার স্ত্রী হীরার চাচাতো বোন। পরে ইউনুস এক শিশুর সঙ্গে তাকে কুদ্দুস মোল্লার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।

কুদ্দুসের মেয়ে সুমাইয়া বেগম বলেন, “রহিমা বাড়িতে স্বাভাবিকভাবেই দিনগুলো কাটিয়েছেন। তিনি নিয়মিত নামাজ পড়তেন এবং সবার সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন। এ বাড়ি–ও বাড়িতে বেড়াতেও গিয়েছেন। তবে তার চোখের সমস্যা ছিল, চোখ দিয়ে পানি পড়ত। এ জন্য বোয়ালমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তাকে ডাক্তার দেখানোও হয়।

সুমাইয়া আরও বলেন, “জমি নিয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে তাদের ঝামেলা চলছে। এই ঝামেলার জন্য তাকে মারধর করা হয়েছে। তাই তিনি বাড়ি থেকে চলে এসেছেন। যদিও তার শরীরে মারপিট করার কোনো আঘাত পাওয়া যায়নি। তবে তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল ছিলেন।”

কুদ্দুস মোল্লার ভাগনে মোহাম্মদ জয়নাল বলেন, “গত শুক্রবার ফেসবুক এবং বিভিন্ন অনলাইনে তিনি রহিমা বেগমের ছবি দেখতে পান। ছবিটি দেখানো হলে রহিমা বেগম ছবিটা নিজের বলে শনাক্ত করেন। এরপর তিনি লোকজনকে বলেন, তার সন্তানেরা তাকে পছন্দ করে না। তিনি বাড়িতে ফিরে যাবেন না। তিনি বাড়ি গেলে তাকে মেরে ফেলা হবে বলেও জানান রহিমা বেগম। তিনি মৃত স্বামী মান্নানের কাছ থেকে দুই কাঠা জমি পেয়েছেন। তার সন্তানেরা এই জমি বিক্রির জন্য চাপ দিচ্ছিলেন।"

এদিকে শুক্রবার (২৪ সেপ্টেম্বর) রহিমা বেগমের ছবি দেখার পর শনিবার সকালে স্থানীয় ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. মোশারফ মোল্লাকে বিষয়টি জানান কুদ্দুসের ভাগনে জয়নাল ও জামাতা নূর মোহাম্মদ। মোশারফ মোল্লা খুলনা সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলের সহযোগিতায় বিষয়টি খুলনা পুলিশকে জানান। মোশারফ মোল্লার সঙ্গে কথা বলে পুলিশ নিশ্চিত হয় রহিমা বেগম সৈয়দপুর গ্রামে আছেন।

জয়নাল বলেন, “রাত সাড়ে ১০টার দিকে ইউপি সদস্য মোশারফ তাকে ফোন করে বলেন, ‘খুলনা থেকে লোকজন এসেছে।’ এরপর খুলনা মহানগর পুলিশের এডিসি আবদুর রহমানের সঙ্গে একজন নারী পুলিশ পুলিশ সদস্যসহ চার–পাঁচজন কুদ্দুস মোল্লার বাড়িতে প্রবেশ করেন। এডিসি আবদুর রহমান গিয়ে রহিমা বেগমের সামনে দাঁড়ান। আবদুর রহমান তাঁকে বলেন, ‘আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন কি না, আমি আবদুর রহমান।’ এ সময় রহিমা বেগমকে আরও কিছু প্রশ্ন করেন তিনি। তবে কোনো প্রশ্নের উত্তরই রহিমা বেগম দেননি। পুলিশ আসার আগে রহিমা বেগম বাড়ির সবার সঙ্গে গল্প করছিলেন। পুলিশ দেখে তিনি চুপ হয়ে যান।”

পরে রহিমা বেগমকে নিয়ে যান পুলিশ। এ সময় কুদ্দুস মোল্লার স্ত্রী হীরা বেগম (৬০), ছেলে আল আমিন (২৫) ও কুদ্দুসের ভাইয়ের স্ত্রী রাহেলা বেগমকেও (৪৫) নিয়ে যায় পুলিশ।

রোবার (২৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে কুদ্দুস মোল্লার বাড়ি ঘুরে দেখা গেছে, একটি টিনের চৌচালা ঘরবিশিষ্ট এই বাড়িতে চারটি কক্ষ রয়েছে। যার একটি কক্ষে রহিমা বেগম থাকতেন।

নূর মোহাম্মদ জানান, রহিমা বেগম প্রথম প্রথম একাই ওই কক্ষেই থাকতেন। তবে শুক্রবার রহিমা বেগমের বিষয়টি জানার পর হীরা বেগম তার সঙ্গে থাকতেন।

ইউপি সদস্য মোশারফ হোসেন মোল্লা (৩৫) বলেন, “কুদ্দুস মোল্লা সৈয়দপুরে ফিরে এসে স্থানীয় জনতা জুট মিলের শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরিবারটি অত্যন্ত নিরীহ। শুক্রবার রাতে রহিমা বেগমের সঙ্গে কুদ্দুসের স্ত্রী–ছেলেসহ তিনজনকে নিয়ে গেছে পুলিশ। তারা বর্তমানে খুলনায় পুলিশি হেফাজতে আছেন। তিনি এ ব্যাপারে খুলনা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। খুলনা পুলিশ জানিয়েছে, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে এবং পরে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হবে।”

ফরিদপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. শাহজাহান বলেন, “খুলনা মহানগর পুলিশের এডিসি আবদুর রহমানের নেতৃত্বে একটি দল বোয়ালমারী সদর ইউনিয়নের সৈয়দপুর গ্রামের কুদ্দুস মোল্লার বাড়ি থেকে রহিমা বেগমকে উদ্ধার করে। এসময় বোয়ালমারী থানা পুলিশ তাদের সহযোগিতা করে।”

এর আগে, গত ২৭ আগস্ট রাত ১০টার দিকে খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা উত্তর বণিকপাড়া এলাকার বাসার উঠানের নলকূপে পানি আনতে যান রহিমা বেগম। কিন্তু এক ঘণ্টা পরও তিনি বাসায় না ফেরায় তার সন্তানেরা খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। নলকূপের পাশে তাদের মায়ের জুতা, ওড়না ও পানির পাত্র পড়ে থাকলেও মাকে তারা খোঁজে পাননি।

এ ঘটনায় ওই রাতেই রহিমা বেগমের ছেলে দৌলতপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। পরদিন তার মেয়ে আদুরী আক্তার বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে থানায় অপহরণ মামলা করেন। এ ছাড়া বিষয়টি র‌্যাবকেও জানানো হয়।

এ মামলায় ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মায়ের সন্ধান চেয়ে ঢাকায় মানববন্ধনের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে দৌড়ঝাঁপ করে আসছিলেন সন্তানেরা।

Link copied!