• ঢাকা
  • বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

পাবনায় দেড় মাসে ৭ খুন, আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে উৎকণ্ঠা


আরিফ আহমেদ সিদ্দিকী, পাবনা
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৪, ২০২৪, ০৫:০৪ পিএম
পাবনায় দেড় মাসে ৭ খুন, আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে উৎকণ্ঠা
জেলার মানচিত্র

হঠাৎ করেই খুনের ঘটনা বাড়ছে পাবনায়। দেড় মাসে জেলায় ঘটেছে ৭টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। যার মধ্যে নভেম্বর মাসের ১৮ দিনে পাঁচটি, অক্টোবর মাসে ঘটেছে দুটি। তবে একটি মৃত্যু নিয়ে পুলিশ এখনও সন্দিহান, সেটি হত্যা নাকি অপমৃত্যু। সর্বশেষ দুইদিনের ব্যবধানে ঘটেছে তিনটি হত্যার ঘটনা।

এসব হত্যাকাণ্ড ছাড়াও বেড়েছে ছিনতাই, সংঘর্ষ, ভাঙচুর, লুটপাট, অপমৃত্যুসহ নানা অপরাধ। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির এমন অবনতিতে জনমনে ভর করছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। ৫ আগস্টের পর পুলিশ এখনও পুরোপুরি মাঠে সক্রিয় না থাকার সুযোগে অপরাধ বাড়ছে বলে মনে করছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।

জেলা পুলিশ ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ নভেম্বর সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে নিজের মাছের খামারে যাচ্ছিলেন পাবনা সদর উপজেলা মৎসজীবী দলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক জালাল উদ্দিন (৪৫)। পথে বেতেপাড়া মোড়ে পৌঁছালে হেমায়েতপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সদস্য মুন্তাজ আলী এবং তাদের লোকজন জালালকে কুপিয়ে হত্যা করেন।

পরদিন ১৭ নভেম্বর রাতে পাবনা শহরে তুষার হোসেন (১৬) নামের এক কিশোরকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ২০২৩ সালের ২১ অক্টোবর স্কুলছাত্র সিয়াম হত্যা মামলার প্রধান আসামি ছিল তুষার।

তার পরের দিন ১৮ নভেম্বর সকালে ঈশ্বরদীর রূপপুরে প্রকাশ্য ওয়ালিফ হোসেন মানিক (৩৫) নামের এক যুবলীগ কর্মীকে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ২০২৩ সালের ১৭ জুন ছাত্রলীগ কর্মী তাফসির আহম্মেদ মনা হত্যা মামলার আসামি ছিলেন তিনি। জামিনে বের হয়ে প্রতিপক্ষের হাতে প্রাণ হারান মানিক।

গত ৮ নভেম্বর সকালে আতাইকুলা থানার গঙ্গারামপুর এলাকা থেকে আসিফ হোসেন (৩২) নামের মানসিক ভারসাম্যহীন যুবকের গলা কাটা মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। আগের দিন ৭ নভেম্বর রাতে এলাকায় একটি জালসা শুনে বাড়ি ফেরার পথে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তিনি।

২৯ অক্টোবর বিকেলে নিখোঁজ হয়েছিলেন আতাইকুলার ভ্যানচালক রবিউল ইসলাম (৪৫)। চারদিন পর, ১ নভেম্বর সকালে তার মরদেহ তৈলকুপি গ্রামের একটি পুকুর থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। দুর্বৃত্তরা তাকে হত্যার পর তার ভ্যানটি নিয়ে লাশ গুম করার জন্য পুকুরের পানিতে ফেলে দেয়।

অপরদিকে গত ১০ অক্টোবর সকালে ঈশ্বরদীতে লিচু বাগান থেকে নয়ন হোসেন (২৮) নামের এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি ইলেকট্রিক্যাল মেকানিক ছিলেন। নিহত নয়নের মুখমণ্ডল ও গলায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন দেখে পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে এবং শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করা হয় তাকে।

এসব হত্যাকাণ্ড ছাড়াও গত ৩০ অক্টোবর সুজানগরের নাজিরগঞ্জ ফেরিঘাট এলাকার পদ্মা নদী থেকে মুকুল হোসেন (৪০) নামের এক পুলিশ কর্মকর্তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মুকুল হোসেন কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ছিলেন।

৩১ অক্টোবর সকালে সুজানগর উপজেলার সাতবাড়িয়ার সিংহনগর স্কুলের সামনে পদ্মা নদীর তীরে ১২ বছরের এক কিশোরের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরদিন ১ নভেম্বর বিকেলে একই উপজেলার সাতবাড়িয়ার কাঞ্চন পার্কের সামনে ভাসমান অবস্থায় ২২ বছরের এক তরুণীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তাদের নাম পরিচয় পাওয়া যায়নি।

রাজনৈতিক বিরোধের বলি হেমায়েতপুরের জালাল উদ্দিনকে হারিয়ে দিশেহারা স্বজনরা। এ বিষয়ে নিহত জালালের স্ত্রী সালমা খাতুনের অভিযোগ, স্থানীয় কবরস্থানের কমিটি গঠন নিয়ে জালালের ওপর ক্ষুব্ধ হন মুন্তাজ ও তার লোকজন। কমিটিতে স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রাধান্য দিয়ছিলেন জালাল, মুন্তাজের কথা শোনেননি। সেই ক্ষোভের আগুনে প্রাণ দিতে হলো তাকে। হত্যাকাণ্ডের পর মামলা হলেও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে না পারায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন জালালের ছেলে লাবু হোসেন।

এদিকে কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ায় আতঙ্কে থাকতেন নিহত তুষারের মা তাসলিমা খাতুন। ফেরানোর চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারেননি একমাত্র ছেলেকে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) পাবনার সভাপতি আব্দুল মতীন খাঁন মনে করেন, ৫ আগস্টের পর পুলিশ প্রশাসন এখনও মাঠে পুরোপুরি সক্রিয় না থাকার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। যখন অপরাধীর বিচার হবে না, তখন অন্য অপরাধীরা আরও উৎসাহি হবে। প্রশাসন এখনই লাগাম টেনে না ধরলে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।

পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) রেজিনূর রহমান বলেন, অতীতের রেকর্ড যদি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পাবনা জেলায় প্রতিমাসে সাধারণত ৪ থেকে ৫টি হত্যা মামলা হয়ে থাকে। চলতি নভেম্বর মাসে ৫টি মামলা হয়েছে। তার মধ্যে ৪টি হত্যা মামলা হয়েছে। আর একটি মৃত্যুর মামলা ময়নাতদন্ত রিপোর্ট এলে বোঝা যাবে সেটি হত্যা নাকি অপমৃত্যু। সেটি সন্দেহজনক হিসেবে আছে। ইতিমধ্যে প্রায় সবগুলো মামলার রহস্য উদঘাটন হয়েছে এবং অনেক আসামিকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।

রেজিনূর রহমান আরও বলেন, “জেলার মামলা পর্যালোচনা করলে সহজেই বোঝায় যায় এগুলো স্বাভাবিক একটি বিষয়। এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। পুলিশের ওপর আস্থা রাখুন, ৫ আগস্ট পরবর্তী সঙ্কট কাটিয়ে পুলিশ আরও বেশি সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। মানুষের আস্থা হারানোর এখানেই কিছু নাই।”

Link copied!