ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর ভারী বৃষ্টিতে শেরপুরে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। বৃষ্টিতে সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার সবকটি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একই সঙ্গে মহারশি, চেল্লাখালী ও ভোগাই নদীর বাঁধের অন্তত সাতটি জায়গা ভেঙে ঝিনাইগাতী উপজেলা সদর ও নালিতাবাড়ী পৌর এলাকাসহ শ্রীবরদীর শতাধিক গ্রাম ডুবে গেছে।
বন্যায় পানিতে প্রাণ হারানো তিনজনের মধ্যে একজনের নামপরিচয় জানা গেছে। তার নাম ইদ্রিস আলী। তিনি নয়াবিল ইউনিয়নের খলিশাকুড়া গ্রামের বাসিন্দা। বাকি দুজনের পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি।
বিষয়টি নিশ্চিত করে নালিতাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ছানোয়ার হোসেন বলেন, “আমরা একজনের পরিচয় শনাক্ত করতে পেরেছি। বাকি দুজনের কোনো পরিচয় এখনো জানা যায়নি। ওই দুইজনের মৃতদেহ উদ্ধারের কাজ চলছে।”
শেরপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, নালিতাবাড়ীর চেল্লাখালী নদীর পানি বিপৎসীমার ৫২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে ও ভোগাই নদীর পানি বিপৎসীমার ৫৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একইসঙ্গে বেড়েছে মহারশি, সোমেশ্বরী, মৃগী ও পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পানি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় ঝিনাইগাতী উপজেলায় ৩২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। চলমান পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে জেলার আমন চাষের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।
মহারশি নদীর খৈলকূড়ায় তিনটি স্থানে বাঁধ ভেঙে ও বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে।
ঝিনাইগাতী উপজেলা সদর বাজার ও উপজেলা পরিষদ ইতোমধ্যেই প্লাবিত হয়েছে। ঝিনাইগাতীর সদর, কাংশা, মালিঝিকান্দা, হাতিবান্দা, ধানশাইলসহ উপজেলার সবকটি ইউনিয়ন ডুবে গেছে।
এ ছাড়া নালিতাবাড়ীর শিমুলতলা, ঘাকপাড়া, মণ্ডলিয়াপাড়া, ভজপাড়া ও সন্নাসীভিটায় ভোগাই ও চেল্লাখালীর বাঁধ ভেঙেছে। নদীর পানিতে তলিয়ে গেছে শেরপুর-নালিতাবাড়ী ভায়া গাজিরখামার সড়ক। এছাড়া জেলার প্রতিটি শহরে জলাবদ্ধতায় দুর্ভোগে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। পাহাড়ি ঢলের পানিতে আকস্মিক প্লাবিত হয়েছে নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতীর অন্তত ১০টি ইউনিয়ন। তলিয়ে গেছে হাজার হাজার একর জমির উঠতি আমন ফসল।
শ্রীবরদীর প্রায় ছয়টি ইউনিয়ন পানিতে ডুবে আছে। এতে খুব কষ্টে আছে স্থানীয়রা। খাদ্যাভাবে আছে মানুষ ও গরু ছাগলসহ গবাদিপশু।
রাস্তাঘাট, ব্রিজ ও কালভার্ট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় চলাচলে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন স্থানীয়রা। বাড়িঘরে পানি ওঠায় রান্না করতে পারছেন না এসব এলাকার লোকজন। ফলে মানুষ ও গবাদি পশুর খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে।
স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ভয়েজ অব ঝিনাইগাতীর সভাপতি জাহিদুল হক মনির বলেন, এর আগে এ রকম পানি দেখিনি। ভারতের পানি আর টানা বৃষ্টিতে আমাদের এখানে বাড়িঘরে পানি ওঠে গেছে। রান্না করতে পারছি না, বাড়িতে থাকার কোনো অবস্থা নেই। ঘরের ভেতরে কোমরসমান পানি। রাস্তায় পানি ওঠায় চলাচলও বন্ধ। শুকনা খাবার ও গো খাদ্যের ব্যাপক সংকট দেখা দিয়েছে।
ঝিনাইগাতী বাজারের ব্যবসায়ী জাফর মিয়া বলেন, আমাদের দোকানপাটে পানি উঠেছে। অনেক ব্যবসায়ীরই ক্ষতি হয়েছে। প্রতিবছরই নদীর বাঁধ ভাঙে আর আমাদের ক্ষতি হয়। কেউ এদিকে দেখে না। নদীর স্থায়ী বাঁধ চাই আমরা।
কৃষক জালাল উদ্দীন বলেন, আমাদের সব ফসল পানির নিচে। এ ধান এহন খাইয়া গেলেগা আমরা বাচমু কেমনে।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন `অক্সিজেন’র সমন্বয়ক আহনাফ নাকিব বলেন, পানির নিচে তলিয়ে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা শেরপুরের ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী, নালিতাবাড়ী উপজেলার কয়েক শ গ্রামের মানুষ।
তিনি আরও বলেন, এ মুহুর্তে উদ্ধারে প্রয়োজন সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিসের রেসকিউ টিম। এদিকে পানির স্রোত খুব বেশি, স্পিডবোট ও বড় ইঞ্জিনচালিত নৌকা, লাইফ জ্যাকেট ইত্যাদি জিনিসের অভাবে বিভিন্ন সংগঠন থেকে চাইলেও উদ্ধার কাজ বা সাহায্য সেভাবে করতে পারছে না। প্রশাসন ও সেনাবাহিনীসহ সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।
ঝিনাইগাতী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ুন দিলদার জানান, এ বছর ঝিনাইগাতীতে সাড়ে ১৪ হাজার হেক্টর জমিতে আমন ধানের চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে চার হাজার হেক্টর জমি সম্পূর্ণ ও সাড়ে পাঁচ হাজার হেক্টর জমির আমন ধানের আবাদ আংশিক নিমজ্জিত রয়েছে। দ্রুত পানি নেমে না গেলে অনেক ক্ষতি হবে।
নালিতাবাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, নালিতাবাড়ী উপজেলায় এ বছর ২৩ হাজার ২০০ হেক্টর আমন আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর আমন আবাদ তলিয়ে গেছে। গতকাল রাতে ২২৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আজ সারাদিন বৃষ্টি হওয়ায় নতুন নতুন এলাকায় বন্যার পানি ঢুকে সম্পূর্ণ তলিয়ে যাচ্ছে।
জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান বলেন, শেরপুরের বন্যা পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে বন্যার্তদের শুকনো খাবার ও গো খাদ্যের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এজন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।