মুড়ি বাঙালির এক ঐতিহ্যবাহী খাবার। রমজান মাসে এই মুড়ি ছাড়া যেন ইফতারের কথা ভাবা যায় না। এক সময় গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই হাতে ভাজা মুড়ি পাওয়া যেত। তবে আধুনিকতার ছোয়ায় আজ হারিয়ে যাচ্ছে হাতে ভাজা মুড়ি।
জানা যায়, কয়েক বছর আগেও নওগাঁ পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ড দুর্গাপুর কলেজপাড়া এলাকাটি একসময় মুড়ি পাড়া হিসেবে পরিচিত ছিল। এই গ্রামের মানুষ শত বছর ধরে লবণ-পানি দিয়ে হাতে মুড়ি ভাজতেন। ১০ বছর আগেও এই গ্রামের প্রায় ৮০টি পরিবার হাতে মুড়ি তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। নিজেরা ধান চাষ থেকে শুরু করে চাল উৎপাদন, এরপর মুড়ি তৈরি করতেন।
বর্তমানে গ্রামটিতে মাত্র সাতটি পরিবার হাতে ভাজা মুড়ি তৈরির সঙ্গে যুক্ত আছে। প্রতিদিন এই গ্রাম থেকে প্রায় ৩০০ কেজি মুড়ি উৎপাদন হচ্ছে। তবে মেশিনের মুড়ির দাপটে প্রতিযোগিতার বাজারে টিকতে না পেরে অনেকে এখন পেশা পরিবর্তন করেছেন।
শান্তি রানি নামের এক মুড়ি কারিগর বলেন, “মেশিনের উৎপাদিত মুড়ির সঙ্গে আমরা পেরে উঠছি না। মেশিনে মুড়ি উৎপাদনে খরচ কম এবং কম সময়ে বেশি মুড়ি ভাজা যায়। হাতে ভাজা মুড়িতে সময় বেশি লাগার পাশাপাশি উৎপাদন খরচও বেশি হয়। এ কারণে অনেকে পেশা পরিবর্তন করে এখন অন্য কাজ করছেন।”
শান্তি রানি আরও বলেন, “মেশিনে মুড়ি ভাজা শুরু হওয়ার পর আমাদের কপাল পুড়তে শুরু করেছে। ২৫-২৬ বছর থেকে মুড়ি ভাজার কাজ করছি। আগে নিজেদের মুড়ি ভাজতাম। গত ছয় বছর ধরে অন্যের মুড়ি ভেজে দেই। ৫০ কেজি মুড়ি ভেজে ৩০০ টাকা পাই। এর মধ্যে খরচ হয় ১৫০ টাকা। যেখানে খড়ি লাগে ১২৫ টাকা এবং লবণ ২৫ টাকা। বসে না থেকে কাজ করলে কিছু টাকা পাওয়া যায় এ জন্যই করছি।”
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলায় প্রায় ১২টি কারখানায় মেশিনের মাধ্যমে মুড়ি উৎপাদন করা হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প (বিসিক) এলাকায় আছে তিনটি। এসব কারখানা থেকে প্রতিদিন প্রায় ১৫ লাখ টাকার মুড়ি উৎপাদন হয়। যা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলা, জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলা এবং রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলায় সরবরাহ করা হয়। তবে রমজান মাসে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় প্রায় ২২ লাখ টাকার মুড়ি উৎপাদন হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
হাতে ভাজা মুড়ির কারিগররা জানান, এখন তাদের ধান ভেঙে আর চাল উৎপাদন করতে হয় না। সরাসরি বাজার থেকে মুড়ির চাল কিনে লবণ-পানি মিশিয়ে হাতে মুড়ি ভাজা হয়। ভোর থেকে শুরু হয় তাদের মুড়ি ভাজার কার্যক্রম। পাঁচ-ছয় ঘণ্টায় দুজন কারিগর ৫০ কেজি চালের মুড়ি ভাজতে পারেন।
দুর্গাপুর গ্রামের মুড়ি বিক্রেতা প্রদীপ বলেন, “বাপ-দাদার সময় থেকে আমরা মুড়ি ভাজা-বিক্রির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ৫০ কেজি চালের মুড়ি ভাজতে ৩ হাজার ২০০ টাকা খরচ হয়। এর মধ্যে ৫০ কেজি চালের দাম ২ হাজার ৯০০ টাকা আর খড়ি-লবণ ও কারিগরের মজুরি ৩০০ টাকা। ৫০ কেজি চাল থেকে ৪৩ কেজি মুড়ি হয়। প্রতি কেজি মুড়ির উৎপাদন খরচ ৭৪ টাকা। বাজারে বিক্রি হয় ৮০ টাকা কেজি। পুরুষরা বিভিন্ন গ্রাম ও হাট ঘুরে মুড়ি বিক্রি করেন।”
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প (বিসিক) এলাকায় শোভা চিড়া ও মুড়ি মিলের মালিক উজ্জল কুমার দাস বলেন, “৫০ কেজি বস্তা চাল থেকে মুড়ি উৎপাদন করতে খরচ হয় ২ হাজার ৫৬০ টাকা। এর মধ্যে চালের দাম পড়ে ২ হাজার ৪০০ টাকা এবং অন্যান্য খরচ ১৫০ টাকা। ৫০ কেজি চাল থেকে মুড়ি হয় সাড়ে ৫০-৫৫ কেজি। প্রতি কেজি মুড়ি উৎপাদনে খরচ পড়ে ৬০ টাকা। যেখানে পাইকারি বিক্রি হয় ৬৫-৭০ টাকা কেজি। রমজান মাসে মুড়ির চাহিদা বেশি থাকায় প্রতিদিন প্রায় ৮-৯ হাজার কেজি মুড়ি উৎপাদন হয়।”
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প (বিসিক) নওগাঁর উপব্যবস্থাপক শামীম আক্তার বলেন, মেশিনে তৈরি মুড়ির দাপটে পেশা টিকিয়ে রাখা অনেকটা কঠিন হয়ে পড়েছে হাতে ভাজা মুড়ি কারিগরদের। এরপরও এখনো মোটামুটি হাতে ভাজা মুড়ির চাহিদা আছে। ঐতিহ্য রক্ষায় কারিগরি প্রশিক্ষণসহ ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ ব্যবস্থা করা হচ্ছে।