• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বৈসাবি উৎসবের আমেজে ভাসছে খাগড়াছড়ি


খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি
প্রকাশিত: এপ্রিল ৫, ২০২৪, ০৩:২৮ পিএম
বৈসাবি উৎসবের আমেজে ভাসছে খাগড়াছড়ি

আর কয়েক দিন পরই শুরু হতে যাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বৈসাবি উৎসব। এ উৎসবের আমেজে খাগড়াছড়ি শহরতলী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত পাহাড়ি পল্লীতে চলছে আনন্দ উল্লাস। আর এই উৎসবকে ঘিরে যেন উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়েছে পার্বত্য জনপদ খাগড়াছড়ি। ইতোমধ্যে পাড়া মহল্লায় বৈসাবি ঘিরে চলছে নান প্রস্তুতি। চলছে ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা, গান বাজনা আনন্দ উল্লাস ও কেনাকাটা। যেন বৈশাখের রঙে ও বৈসাবির সাজে সেজেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম।

বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। আর পাহাড়ের প্রাণের উৎসব যেন বৈসাবি। পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত তিনটি জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী সামাজিক উৎসব চাকমাদের বিজু, মারমাদের সাংগ্রাই ও ত্রিপুরাদের বৈসুর আদিক্ষ্যরে মিলিত ‘বৈসাবি’ ঘিরে পাহাড়ি পল্লীগুলো সেজেছে যেন বৈসাবি সাজে। পাহাড়ি মেয়েরা বৈসাবিতে নিজেদের রাঙিয়ে নিতে যেন আকুল মনে অপেক্ষার প্রহর গুনছে।

এ উৎসবকে ঘিরে শুক্রবার (৫ এপ্রিল) থেকে খাগড়াছড়িতে শুরু হয়েছে ৫ দিনব্যাপী বৈসাবি মেলা। শান্তির পায়রা উড়িয়ে ও মারমাদের জলকেলি পানি ছড়িয়ে এ মেলার উদ্বোধন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রনালয়ের প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা।

খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মংসুই প্রু চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্টানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন খাগড়াছড়ি রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ মো. আমান হাসান, গুইমারা রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রাইসুল ইসলাম, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরী অপু, খাগড়াছড়ি ডিজিএফআইর ডেট কমান্ডার কর্ণেল আব্দুল্লাহ মো. আরীফ, খাগড়াছড়ি সদর জোন কমান্ডার লে. কর্ণেল আবুল হাসনাত জুয়েল, খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান, খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার মুক্তা ধর, খাগড়াছড়ি পৌরসভার মেয়র নির্মলেন্দু চৌধুরীসহ জেলা পরিষদের সদস্য ও বিভিন্ন দপ্তরের বিভাগীয় প্রধান ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বৈসাবি বাংলাদেশের তিন পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব। বৈসু, সাংগ্রাই, বিজু এই তিন নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে বৈসাবি নামের উৎপত্তি। তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালন করে বাংলা নববর্ষ। পুরোনো বছরের কালিমা আর জীর্ণতাকে ধুয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেয় তারা।

মেলায় পাহাড়ি সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী পাঁচন রান্না, বেইন বুনন, রচনা প্রতিযোগিতা, চাকমা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী ঘিলে খেলা, ত্রিপুরাদের সুখই খেলা ও মারমাদের ‘ধ’ খেলাসহ মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক পরিবেশনা চলছে। এসব ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা শুধু মেলায় নয়, দুর্গম পাহাড়ি সকল পল্লীতে যুবক-যুবতীরা এসব খেলায় মেতে রয়েছে।

বংশ পরম্পরায় পালিত এই উৎসবের সঙ্গে আধুনিকতার ছোঁয়া আর বাংলার বৈসাবি হয়ে উঠেছে সর্বজনীন অন্য এক পাহাড়ি উৎসব। এই উৎসবে সবার অংশগ্রহণে সাম্প্রাদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধি পাবে এমনটাই প্রত্যাশা স্থানীয়দের।

জানা যায়, বর্ষবরণ উৎসবকে ত্রিপুরারা বৈসু, মারমারা সাংগ্রাই ও চাকমারা বিজু বলে অভিহিত করে এবং এগুলো বৈসাবি নামে পরিচিত। সাধারণত বছরের শেষ দুইদিন এবং নতুন বছরের প্রথম দিন বর্ষবরণ উৎসব বৈসাবি পালিত হয় খাগড়াছড়ি, রাংগামাটি ও বান্দরবানে।

চাকমাদের বর্ষবরণ উৎসব হলো বিজু। তারা তিন ভাগে বিজু উৎসব পালন করেন। চৈত্র মাসের ২৯ তারিখে ফুল বিজু, ৩০ তারিখে মূল বিজু এবং বৈশাখের প্রথম দিনে গজ্যাপজ্যা বিজু নামে অনুষ্ঠান পালন করেন। ফুল বিজুর দিন গভীর অরণ্য থেকে ফুল সংগ্রহ করে চারভাগে ভাগ করে একভাগ ফুল ও নিমপাতায় ঘরবাড়ি সাজায়, দ্বিতীয় ভাগ ফুল বৌদ্ধ বিহারে বুদ্ধের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে প্রার্থনা করে এবং ভিক্ষুসংঘ থেকে প্রদত্ত ধর্মোপদেশ শ্রবণ করে, তৃতীয় ভাগ ফুল নদী, খাল বা পুকুরের পাড়ে  তৈরি পূজামণ্ডপে রেখে প্রার্থনা করে এবং চতুর্থভাগ ফুল প্রিয়জনকে উপহার দেয় এবং বয়োজ্যেষ্ঠদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানায়।

মূল বিজুর দিনে অসংখ্য কাঁচা তরকারি সংমিশ্রণে পাচন বা ঘণ্ট তৈরি করা হয়। এছাড়া পায়েস ও নানা ধরনের পিঠা তৈরি করা হয় এবং মাছ-মাংস রান্না করা হয়। বিভিন্ন ধানের খই, নাডু, সেমাই ও পাহাড়ি মদও থাকে। এদিন চাকমারা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করে র্যালিতে যোগ দেয়, অবালবৃদ্ধবনিতা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায় এবং শিশুকিশোর তরুণ তরুণীরা খেলাধুলায় মেতে ওঠে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িঘর, উঠান ও গোশালায় প্রদীপ জ্বালিয়ে সবার মঙ্গল কামনা করা হয়। মন্দিরে গিয়ে মোম জ্বালিয়ে ফুল দিয়ে বুদ্ধের পূজা করা হয়।

Link copied!