• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কেমন চলছে পাবনা মানসিক হাসপাতাল


আরিফ আহমেদ সিদ্দিকী, পাবনা
প্রকাশিত: অক্টোবর ১০, ২০২২, ০৯:২৯ এএম
কেমন চলছে পাবনা মানসিক হাসপাতাল

আজ ১০ অক্টোবর। বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা, সচেতনতা, চিকিৎসা আর নিরাময়ের আশ্রয়স্থল হিসেবে দেশের একমাত্র মানসিক রোগ নিরাময় প্রতিষ্ঠান পাবনা মানসিক হাসপাতাল। দিনদিন এই চিকিৎসা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানটি নিজেই মানসিক রোগীতে পরিণত হতে চলেছে। একের পর এক প্রশাসন বদল হলেও বদলায়নি এই প্রতিষ্ঠানে নানা অনিয়ম।  

নানা অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বেচ্ছাচারিতা, রোগীদের সঙ্গে দুব্যার্বহার, দালালদের দৌরাত্মসহ নানা কারণেই আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে চলে এসেছে সরকারি এই স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তিকৃত রোগীদের জন্য রয়েছে প্রতিদিন ১২৫ টাকা বরাদ্দের খাবার। জনবল সংকটে ব্যাহত চিকিৎসা সেবা, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্টদের জন্য সরকারি ভবনগুলো পরিত্যক্ত ঘোষণার পরও ঝুঁকি নিয়ে অবৈধভাবে বসবাস করছেন বহিরাগতসহ হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা। এতে করে গেল আট বছরে সরকারকে গুনতে হচ্ছে প্রায় কোটি টাকার বিদ্যুৎ বিল।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৩ সালে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে নির্ধারণ করা হয় পাবনা মানসিক হাসপাতালের রোগী প্রতি প্রতিদিন ১২৫ টাকার খাবার বাজেট। বর্তমান বাজারের ঊর্ধ্বগতি প্রকাশ্য হলেও কেবল এর প্রভাব পড়েনি পাবনা মানসিক হাসপাতালের রোগীদের খাবার বাজেটে। গত ৯ বছরেও একই বাজেটে রোগীদের খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। যে খাবার একজন রোগীর জন্য যথেষ্ট বা মানসম্পন্ন নয়। পাশাপাশি চিকিৎসক-কর্মচারী সংকটে ধুঁকছে হাসপাতালটি। মাত্র ৯ জন চিকিৎসক দিয়ে চলছে ৫০০ শয্যার এই হাসপাতাল। অভিযোগ রয়েছে, সংকট নিরসনে বরাবরই উদাসীন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। পরিত্যক্ত ঘোষণার পরও ঝুঁকি নিয়ে অবৈধভাবে বসবাস করছেন বহিরাগতসহ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী।

তথ্য মতে, সকালের নাস্তায় সপ্তাহে তিনদিন খিচুরি, বাকি চারদিন সুজি-রুটি। আর বিকেলের নাস্তায় বিস্কুট। দুপুরে ও রাতের খাবারে মাছ, ব্রয়লার মুরগির মাংস। সঙ্গে কখনও ডিম, সবজি, ডাল। এই হচ্ছে পাবনা মানসিক হাসপাতালের মানসিক রোগীদের খাবারের তালিকা।

এসব খাবারের জন্য একজন রোগীর জন্য দৈনিক বরাদ্দ মাত্র ১২৫ টাকা। ২০১৩ সালে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে একজন মানসিক রোগীর খাবার বরাদ্দ ৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১২৫ টাকা করা হয়। অথচ নয় বছর পরও সেই একই বরাদ্দে চলছে মানসিক হাসপাতালের রোগীদের খাবার সরবরাহ। এই ১২৫ টাকার মধ্যে আবার ভ্যাট ও আয়কর সংযুক্ত। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, মানসিক রোগীদের উচ্চমাত্রার ওষুধ সেবনের সঙ্গে দরকার পুষ্টি সমৃদ্ধ বেশি পরিমাণে খাবার।

জানা যায়, এক ঠিকাদারের মামলায় হাসপাতালের টেন্ডার কার্যক্রমের ওপর আদালতের অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার কারণে আড়াই মাস বাকিতে খাবার কিনে সরবরাহ করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এতে বকেয়া পড়েছে প্রায় ৩৮ লাখ টাকা। বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে বারবার জানিয়ে কোনো নির্দেশনা না পাওয়ায়, সম্প্রতি রোগী ভর্তি বন্ধ ও ভর্তি থাকা রোগীদের বাড়িতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। যদিও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে ও মামলা খারিজ হওয়ায় সে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়। তবে রোগীদের খাবারের সেই বকেয়া টাকা পরিশোধ করা নিয়ে দুশ্চিন্তায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

এদিকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ বিভিন্ন জনবল সংকটে ধুঁকছে বিশেষায়িত এই হাসপাতালটি। মাত্র ৯ জন চিকিৎসক দিয়ে চলছে চিকিৎসাসেবা। ৩১টি চিকিৎসক পদের ২১টি-ই শূন্য দীর্ঘদিন ধরে। এতে চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। চিকিৎসকরা বলছেন, হাসপাতালটি চূড়ান্ত অবহেলার শিকার। বিষয়টি বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও, কোনো সুরাহা হচ্ছে না বলে জানান হাসপাতালের পরিচালক।

২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পাবনা গণপূর্ত বিভাগ পাবনা মানসিক হাসপাতালের আবাসিক কোয়াটার ও কটেজ বসবাসের অনুপযোগী হিসেবে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে চিঠি দেয় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে। এরপর থেকে পাবনা মানসিক হাসপাতালের সরকারি বাসায় কর্মকর্তা-কর্মচারী বসবাসের অনুমতি বন্ধ করে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

আইনগতভাবে সবকিছু বন্ধ থাকলেও হাসপাতালের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী, আউট সোর্সিংয়ের কিছু কর্মচারী ও বহিরাগত লোকজন ঝুঁকি নিয়েই বসবাস করছেন এসব সরকারি আবাসিক স্থাপনায়। পরিত্যক্ত ঘোষণা করলেও বিচ্ছিন্ন করা হয়নি বিদ্যুৎ সংযোগ। এজন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে মাসে গুনতে হচ্ছে মোটা অংকের বিদ্যুৎ বিল, আট বছরে আনুমানিক তার হিসাব দাঁড়ায় প্রায় কোটি টাকা।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ৬০টি পরিবার বসবাস করছে এসব ভবনে। তাদের মধ্যে হাসপাতালের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী, আউট সোর্সিং কর্মচারী, আনসার সদস্য ও কিছু বহিরাগত লোকজন। তারা সবাই হাসপাতালের অনুমোদন ছাড়া এখানে বসবাস করছেন।

হাসপাতালে ভর্তি হতে আসা দেশের বিভিন্ন এলাকার রোগীর পরিবারের জন্য যে দশটি কটেজ ছিল, তার মধ্যে ৫টি একেবারে ফাঁকা পড়ে আছে। বাকি ৫টির মধ্যে একটিতে হাসপাতালের নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকা আনসার সদস্যরা রয়েছেন। কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে অন্য চারটিতে বসবাস করেন আউট সোর্সিংয়ে কর্মরত কর্মচারীসহ অন্যান্যরা।

এদিকে হাসপাতালে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, মাঝে মধ্যেই কর্তব্যরত নার্স, ব্রাদারসহ কর্মচারীরা মানসিক রোগীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন। এমন অভিযোগ কয়েকটি ওয়ার্ডে ঘুরে চিকিৎসাধীন রোগীদের কাছ থেকে জানা যায়।

হাসপাতালের প্রধান ফটক পার হওয়ার পর রোগী ভর্তির কার্যক্রমের জন্য রয়েছে জরুরি বিভাগ। সেখানেও দালালের দৌরাত্ম বেড়েছে। এই দালালির সঙ্গে আনসার সদস্যরাও যুক্ত রয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। রোগীদের সিরিয়াল আগে পাইয়ে দেওয়া, নতুন পুরাতন রোগীদের দ্রুত ডাক্তারের চেম্বারে নেওয়ার ক্ষেত্রে রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে টাকা নেয়ার অভিযোগ রয়েছে আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে আনসার সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তারা কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তবে তারা দাবি করছেন, রোগীদের দ্রুত সেবার কাজে তারা নিয়োজিত রয়েছেন। অথচ তাদের দায়িত্ব শৃঙ্খলা রক্ষা করার।

তথ্য মতে, হাসপাতালে একটি সক্রিয় সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে খাবার সরবরাহের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। ওই সিন্ডিকেটের বাইরে যাতে কেউ খাবার সরবরাহ করতে না পারে সে জন্য তারা মেয়াদ উত্তীর্ণের আগে নানা অপকৌশল প্রয়োগ করে থাকেন। এমন কি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন সময়ে নানা হুমকি ধামকি দেয়ার অভিযোগও রয়েছে। রোগীদের ওষুধ বিতরণে রয়েছে নানা অনিয়মের অভিযোগ। তবে হাসপাতালের সমাজ সেবা দপ্তরের দাবি, সংকটময় মুহূর্তে তাদের দপ্তর থেকে দামি দামি ওষুধ ক্রয় করে রোগীদের জন্য দেওয়া হয়েছে। নার্স ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে টাকা নিয়ে রোগীদের সাথে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠে এসেছে।  

হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শফিউল আযম বলেন, মানসিক রোগীদের উচ্চমাত্রার ওষুধ সেবনের সাথে দরকার পুষ্টি সমৃদ্ধ বেশি পরিমাণে খাবার। কিন্তু বর্তমান ঊর্ধ্বগতির বাজারে এই বরাদ্দে যা কোনোভাবেই সম্ভব না।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আবাসিক (আরপি) সাইকিয়াট্রিস্ট মো. মাসুদ রানা সরকার জানান, পর্যাপ্ত চিকিৎসক প্রয়োজন। অথচ ৩ জন সাইকিয়াট্রিস্ট দিয়ে এই হাসপাতালের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে একজন চিকিৎসক পাবনা মেডিকেল কলেজের। চিকিৎসক সঙ্কট দূর হলে অবশ্যই রোগীকে কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. রতন কুমার রায় বলেন, “বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, আবাসন সঙ্কটসহ বিভিন্ন জনবল সংকটে ধুঁকছে বিশেষায়িত এই হাসপাতালটি। মাত্র ৯ জন চিকিৎসক দিয়ে চলছে চিকিৎসাসেবা। ৩১টি চিকিৎসক পদের ২১টি-ই শূন্য দীর্ঘদিন ধরে। এতে চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের।

সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ডা. শাফকাত ওয়াহিদ বলেন, “এখানে অনেক বাসভবনই বসবাসের অনুপযোগী ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে মোটামুটি ৫০টির বেশি পরিবার বসবাস করছে। আমি এখানে যোগদান করার পর দেখলাম যে কোনো প্রকার অনুমতি ছাড়া তারা সেখানে বসবাস করছে, তখন তাদের আমি বাসা ছেড়ে দিতে আদেশ দিয়েছি। তার মধ্যে অনেকে আবার বাসা ছাড়তে সময় চেয়েছে। এজন্য কিছু সময় তাদের দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন বাসা ছেড়ে দিয়েছে, বাকিরাও চলে যাবে আশা করি। আবার কেউ কেউ থাকার অনুমতি চাচ্ছে বা থাকার চেষ্টা করছে, সেটি মেনে নেওয়া হবে না।”

পরিত্যক্ত ঘোষণাকৃত বাসভবনে বিদ্যুৎ সংযোগের বিষয়ে পরিচালক বলেন, “হাসপাতালের সকল ভবনই হচ্ছে গণপূর্ত বিভাগের অধীনে। এখানে বিদ্যুৎ, গ্যাস সরবরাহ সবই হচ্ছে তাদের নিয়ন্ত্রণে। বিলগুলো শুধু হাসপাতাল থেকে দেওয়া হয়। আমি নতুন এসে দেখেছি তাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য। আমিও চিঠি দিয়েছি। আরও অনেক আগেই তাদের উদ্যোগ নেয়ার দরকার ছিল। কিন্তু কেন হয়নি সেটি বলতে পারছি না।”

স্বদেশ বিভাগের আরো খবর

Link copied!