দরজায় কড়া নাড়ছে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর। ইতোমধ্যে অনেকেরই ঈদের কেনাকাটা শেষ হয়েছে। তবে এবার ঈদে কোনো আনন্দ নেই সোমালিয়ান জলসদ্যুদের হাতে জিম্মি নাবিক নাজমুল হকের পরিবারে।
সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার ভদ্রঘাট ইউনিয়নের প্রত্যন্ত চর-নূরনগর গ্রামের আবু শ্যামা ও নার্গিস দম্পতির একমাত্র ছেলে নাজমুল হক।
সরেজমিনে তার বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, তার পরিবারে হচ্ছে না কোনো ধরনের কেনাকাটা। নেই ভালো কিছু রান্নার প্রস্তুতিও। অন্যবারের ঈদগুলো হাসি-খুশির থাকলেও এবার ঈদ তাদের কাছে নীরব কান্নার। পরিবারের উপার্জনশীল ব্যক্তি বন্দিদশায় মহাসাগরে তলিয়ে গেছে নাজমুলের পরিবারের ঈদ আনন্দ। প্রতিটি মুহূর্তে নামজুলের অপেক্ষায় রয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। কখন জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হয়ে মা-বাবার বুকে ফিরে আসবে সন্তান নাজমুল।
জানা যায়, নাজমুল হকের বয়স মাত্র ২৩ বছর। দুই ভাই-বোনের মধ্যে নাজমুল বড়। ছোটবেলাতেই মারা গেছে তার তিন ভাই-বোন। মাত্র ২০ বছর বয়সে জাহাজে চাকরি পাওয়ার সুবাদে পরিবারের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। কিন্তু গত ১২ মার্চ অপহৃত হওয়ার পর থেকেই ছেলের মুক্তির সংবাদের অপেক্ষায় রয়েছেন নাজমুলের মা-বাবাসহ পরিবারের সদস্যরা। সন্তানকে ফিরে পেতে আল্লাহর দরবারে নামাজ, রোজা ও দোয়া করে সময় পার করছেন তারা। দির-রাত ছেলের ছবি এবং মোবাইলে কোনো সংবাদ এলো কি না তা দেখছেন তারা। প্রতীক্ষার প্রহর যেন তাদের শেষ হতে চাইছে না। অপহৃতের পর থেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন নাজমুলের বৃদ্ধ বাবা আবু শ্যামা। কান্না ও আহাজারিতে দিন- রাত পাড় হচ্ছে মা নার্গিস ও বোন নাজমার।
নাজমুলের প্রতিবেশী ও স্বজনরা বলেন, “নাজমুল খুবই ভদ্র ও ভালো ছেলে। পড়াশোনা করা অবস্থাতেই চাকরি হয় তার। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি নাজমুল। প্রতিবছর ঈদের কেনাকাটা করলেও এবার কিছুই হয়নি তাদের। ছেলের সুস্থতা আর নিরাপদে ফিরে আসার অপেক্ষা করছেন তার বাবা-মা। প্রশাসনসহ অনেকেই তাদের খোঁজখবর নিতে আসে। শুধু সান্ত্বনা দিয়েই যায়। সন্তানের ভালো সংবাদের অপেক্ষা আর শেষ হয় না তাদের। আমরা চাই সরকার যেন ঈদের আগেই ২৩ জন নাবিককে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে।”
নাজমুলের মা নার্গিস বেগম বলেন, “নাজমুলের আয়েই আমাদের সংসার চলে। আমার ছেলেটা এখনো বিয়ে করেনি। নাজমুল অনার্সে ভর্তির পরেই চাকরি হয়েছে। চাকরি হওয়ার পরে প্রথমে গিয়ে ৩ বছর ছিল। এরপর এসে আবার মাস তিনেক হলো গেছে। ঢাকা থেকে বিমানে দক্ষিণ কোরিয়া গিয়ে ওখান থেকে জাহাজে উঠেছে নাজমুল।”
নার্গিস বেগম আরও বলেন, “যখন তারা জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হয় তখন আমার বুকের মানিক বলেছিল, মা ২০ থেকে ২৫ দিনের খাবার আছে, আর ২০০ মেট্রিক টন পানি আছে। দস্যুরা কথায় কথায় মাথায় বন্দুক ধরে রাখে, জাহাজে খাবার সংকট, পানি সংকট এমন নানা দুশ্চিন্তায় আমার ঘুম আসে না।”
তিনি আরো বলেন, “ছেলে জলদস্যুদের হাতে জিম্বি আছে। ছেলেকে ছাড়া আমরা কীভাবে ঈদের কেনাকাটা করব, ভালো খাবার খাব আপনারাই বলেন?” এসময় তিনি ছেলেকে ঈদের আগে ফিরে পেতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দ্রুত মুক্তির দাবি করেছেন।
কামারখন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহীন সুলতানা বলেন, “জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার পর থেকেই জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের পরিবারের সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছি। অপহৃত নাবিকদের উদ্ধারের বিষয়টি নিয়ে সরকার ও জাহাজ মালিকের পক্ষ থেকে সব ধরনের চেষ্টা চলছে। পরিবারের একমাত্র ছেলে নিখোঁজ থাকলে তাদের তো আসলে ঈদ বলতে কিছুই থাকে না। তারপরও আমরা তাদের পাশে আছি। দু-তিনদিনের মধ্যেই নাজমুলের পরিবারকে আমরা সহযোগিতা করব।”
এর আগে গত ১২ মার্চ মোজাম্বিকের মাপুতো থেকে কয়লা নিয়ে আবার আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরে যাওয়ার পথে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’। জাহাজে ২৩ নাবিক রয়েছেন। যাদের সবাই বাংলাদেশি।
জলদস্যুদের কবলে পড়া জাহাজটি চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগোষ্ঠী কবির গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিং করপোরেশনের। জাহাজটি সাধারণ পণ্য পরিবহন করে। ২০ মার্চ দুপুরে জলদস্যুদের প্রথম ফোন পায় মালিকপক্ষ।