• ঢাকা
  • রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

নামেই স্বাস্থ্যকেন্দ্র, নেই কোনো চিকিৎসাসেবা


জীতেন বড়ুয়া, খাগড়াছড়ি
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৩, ১০:০৪ এএম
নামেই স্বাস্থ্যকেন্দ্র, নেই কোনো চিকিৎসাসেবা
এতবড় হাসপাতাল, অথচ কোনো ডাক্তার নেই, ওষুধ নেই

সর্দি-কাশির সঙ্গে জ্বর থাকায় দুই কিলোমিটার দূর থেকে মো. মনির অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে এসেছেন উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। উপস্বাস্থ্য সহকারী কিছু ওষুধ স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে দিলেও বাকি ওষুধ কিনতে বললেন বাইরে থেকে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কথা হয় মনিরের সঙ্গে। আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, এত বড় হাসপাতাল অথচ কোনো ডাক্তার নেই, ওষুধ নেই। এ চিত্র খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার তবলছড়ি পল্লী স্বাস্থ্যকেন্দ্রের।

তবলছড়ি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, ঝোপঝাড়ে ঘেরা ভুতুড়ে বাড়ির মতো দেয়ালঘেরা একতলা বিশিষ্ট বিশাল একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রতিটি দেয়ালে দেখা দিয়েছে ফাটল, ছাদ থেকে খুলে পড়ছে পলেস্তারা। অধিকাংশ দরজা-জানলা ভাঙা। বারান্দায় এবং হাসপাতালের চারদিকে ঘুরছে বেশ কয়েকটি গরু-ছাগল। সে অবস্থাতেই একটি রুমে রোগী দেখছেন উপসহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। আরেক রুমে বসে আছেন পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের একজন দাই নার্স। হাসপাতাল থেকে এক শ গজ দূরে রয়েছে চিকিৎসকদের থাকার জন্য পরিত্যক্ত একতলা তিনটি বাড়ি। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই এটি ১০ শয্যাবিশিষ্ট মাটিরাঙ্গা তবলছড়ি পল্লী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।

পল্লী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কর্মরত উপসহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা স্বপন কুমার দেবনাথ বলেন, “১২ বছর ধরে একমাত্র আমিই চাকরি করছি এই হাসপাতালে। অনেকে আসেন এক দুই মাস পর বদলি হয়ে চলে যান নয়তো প্রেষণে চলে যান। মূলত এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। রোগীর সংখ্যা খুব কম প্রতিদিন গড়ে ৮ থেকে ১৫ জন রোগী আসেন। মূলত দরিদ্র লোকজনই আসেন চিকিৎসা নিতে। এখানে বিনা মূল্যে পাঁচ-ছয় প্রকারের ওষুধ দেওয়া হয়। এই কমপ্লেক্সের নামে কোনো ওষুধ বরাদ্দ নেই। লোকজনের কথা চিন্তা করে মাটিরাঙ্গা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে কিছু ওষুধ এখানে দেওয়া হয়ে থাকে।”

একই কথা বলেন দাই নার্স অনূরা চাকমাও। তিনি বলেন, অনেকে এলেও বদলি হয়ে চলে যান। তিনি ছাড়া এখানে কেউ সহজে চাকরি করতে চান না। স্থানীয় বাসিন্দা হওয়ায় চাকরির শুরু থেকে তিনিই একমাত্র চাকরি করছেন এখানে।  

পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ থেকে অতিরিক্ত দায়িত্বে রয়েছেন রুইম্রাশোং মারমা নামের একজন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শক। তিনি সপ্তাহে এক দিন আসেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।

মোবাইল ফোনে রুইম্রাশোং মারমা বলেন, মাটিরাঙ্গা উপজেলার আলুটিলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তার কর্মস্থল। তবে অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকায় প্রতি সপ্তাহে একবার পল্লী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসে রোগী দেখেন তিনি।

খাগড়াছড়ি সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১০ শয্যাবিশিষ্ট পল্লী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মেডিকেল অফিসার ১ জন, ল্যাব টেকনিশিয়ান ১ জন, অফিস সহায়ক ২ জন, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ২ জন, ওয়ার্ড বয় ১ জন নিয়োগ প্রাপ্ত হলেও স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি চালু না থাকায় তারা জেলা সদর হাসপাতালসহ উপজেলার বিভিন্ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রেষণে কর্মরত রয়েছেন।

স্থানীয় বাসিন্দা অমল বিকাশ চাকমা (৭৬) ও অমল রঞ্জন ত্রিপুরা (৮০) বলেন, ১৯৬২ সালের শেষের দিকে হাসপাতালটির তৈরির কাজ শুরু হয়। ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে পর্যন্ত খুব জমজমাট ছিলো হাসপাতালটি। সে সময় জেলার অনেক লোকজন আসতেন এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে। কিন্তু স্বাধীনতাযুদ্ধের পরপরই হাসপাতালটি বন্ধ হয়ে যায়।

মাটিরাঙ্গা উপজেলা চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি চালু হলে সীমান্তবর্তী মাটিরাঙ্গা উপজেলার বরনাল, তবলছড়ি এবং তাইন্দং এ তিন ইউনিয়নের প্রায় ৫০ হাজার মানুষের উপকারে আসত।

খাগড়াছড়ি সিভিল সার্জন ছাবের আহমেদ বলেন, যেসব চিকিৎসক এবং ল্যাব টেকনিশিয়ান নিয়োগ পান তারা যে কাজ করবে সে যন্ত্রপাতি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নেই। তাছাড়া দুর্গম এবং বিদ্যুৎ ও পানির ব্যবস্থা না থাকায় সহজে ওখানে কেউ থাকতে চান না। স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি চালু করতে হলে নতুন করে মেরামত করতে হবে। চিকিৎসা দেওয়ার যন্ত্রপাতি থেকে একটি নতুন হাসপাতাল গড়তে যা যা প্রয়োজন তার সবকিছু লাগবে। এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিত ও মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে। আর খাগড়াছড়ি হাসপাতালে যে চিকিৎসক প্রেষণে রয়েছে তিনি সপ্তাহে দুই দিন গিয়ে চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসবেন।

খাগড়াছড়ি স্বাস্থ্য বিভাগের আহ্বায়ক ও জেলা পরিষদ সদস্য মো. আব্দুল জব্বর বলেন, স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি কীভাবে চালু করা যায় এ ব্যাপারে সিভিল সার্জনের সঙ্গে কথা হয়েছে। পল্লী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এখন থেকে প্রতি সপ্তাহে দুই দিন একজন চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা দেবেন।

Link copied!