শ্রম আর মেধা দিয়ে অনেকেই জীবনের উচ্চ শিখরে আরোহন করেছেন। আর্থিক অনটন তাদের কখনো দমাতে পারেনি। সামান্য চাকরি করে যখন সংসার জীবন থেমে যাচ্ছিল। ঠিক তখনি এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ শিখে মেধা খাটিয়ে আয় করছেন লাখ লাখ টাকা। আর কয়েক হাজার বেকার যুবক তার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ঘরে বসেই বিপুল টাকা রোজগার করছেন। এই সফল ফ্রিল্যান্সারের নাম হামিদুর রহমান।
একজন পেশাদার ফ্রিল্যান্সার হিসেবে পরিচিত লাভ করেছেন নেট দুনিয়ায়। বর্তমানে হামিদুর রহমান ঘরে বসে মাসে আয় করছেন ৬-৭ লাখ টাকা। একই সঙ্গে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছেন বেকার যুবকদের। এই সাফল্যের গল্প শুনিয়েছেন তিনি নিজেই। তার বাড়ি টাঙ্গাইল পৌর শহরের কাগমারা এলাকায়।
সাফল্যের কথা তুলে ধরে হামিদুর রহমান বলেন, “২০১৫ সাল একটি সিগারেট কোম্পানি ঢাকা টোবাকোতে কাজ শুরু করি। সেই প্রতিষ্ঠানের এক ভাইয়ের কাছে ফ্রিল্যান্সিং কথাটি শুনেছিলাম। এরপর টাঙ্গাইল শহরে দর্জি বাড়ি ফ্যাশন হাউজের শোরুমে কাজ করি। সেখান থেকে চলে যাই ভিভো মোবাইল কোম্পানিতে। সেই কোম্পানিতে ব্র্যান্ডের শোরুমে সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করতাম। রাত ১০টায় বাসায় গিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজগুলো করতাম। তখন থেকে ভেবেছি কীভাবে এই কাজ করা যায়। চাকরির পাশাপাশি ইউটিউবে প্রচুর ভিডিও দেখেছি। এরপর আমি অনলাইনভিত্তিক এডুকেশন প্লাটফর্ম থেকে একটি কোর্স করি।”
টাঙ্গাইলের পুলিশ লাইনস আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন হামিদুর। বিবেকানন্দ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন কাগমারি মাওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজে। এরমধ্যে তিনি বিয়ে করেন। এরপর তার চিন্তা বেড়ে যায়। দোকানে ৬ হাজার টাকা বেতনের চাকরি শুরু করেন। বাসা ভাড়া দিয়ে কোনো রকমে চলে সংসার। চাকরিরত অবস্থায় তার সহকর্মীকে দেখেন ফ্রিল্যান্সারের কাজ করতে। পরে এক বন্ধুর ল্যাপটপে কাজ করতে যান। নষ্ট হবে বলে সেই বন্ধু তাকে ল্যাপটপ ধরতে দেয়নি। মনের ভেতর তখন তার জেদ চাপে। তার বাবা পুলিশে চাকরি করেন। ওইদিনই বাবাকে একটি ল্যাপটপ কিনে দিতে বলেন।
ল্যাপটপ কেনার পর এক বন্ধুর অনুপ্রেরণায় হামিদুরের মাথায় আসে ফ্রিল্যান্সার হওয়ার। প্রথম অবস্থায় কিছুটা আয় করতে শুরু করলে আরও আগ্রহ বেড়ে যায়। চাকরি ছেড়ে পেশাদারভাবে শুরু করেন ফ্রিল্যাল্যান্সিংয়ের কাজ। সেই আয়ের টাকা দিয়ে গাড়ি-বাড়ি সব করেছেন তিনি। বর্তমানে তার মাসে আয় হচ্ছে ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা।
ফ্রিল্যান্সিং থেকে আয়ের টাকা দিয়ে টাঙ্গাইল শহরের হাউজিং সোসাইটি আবাসনে গড়ে তুলেছেন ফ্রিল্যান্সার বিডি ইউস্টিটিউট। শিক্ষিত বেকারদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিই তার লক্ষ্য।
হামিদুর রহমান বলেন, “ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের ওপরে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কোর্সগুলো করেছিলাম। আমি মার্কেটপ্লেসে ও ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের বিভিন্ন ধরনের সার্ভিসগুলো দিয়ে ইউএসএ, কানাডা অস্ট্রেলিয়া, জার্মান, জাপান, সুইজারল্যান্ড, ইন্ডিয়া, সৌদি আরব, দুবাইসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের কাজগুলো করে আসছি। প্রথম প্রথম খুব অসুবিধায় পড়তে হতো। একটি কাজ পেলে কোনো ধরনের সাপোর্ট পেতাম না। কাজগুলো গুছিয়ে নিতে পারতাম না। নিজে নিজেই কাজগুলো অনেক কষ্ট করে করতে হতো।”
সফল এই ফ্রিল্যান্সার আরও বলেন, “প্রথম ২০ দিনের মাথায়-ই একটি ১০০ ডলারের পেমেন্টে পাই। কাজটি ছিল ইউএসএর একটি কোম্পানির এবং আমি সেই কাজটি প্রফেশনালভাবে করে দিতে পেরেছিলাম। তারা কাজে খুশি হয়ে আমাকে আমাকে ১০ ডলার টিপস দিয়েছিল। ভালো কাজের মূল্যায়নে অনুপ্রেরণাটা আরও বেড়ে যায়। পরবর্তী কালে দক্ষ হতে থাকি, আর ভালোভাবেই কাজ পেতে থাকি এবং প্রতি মাসে লাখ টাকা আয় করা শুরু করি। তারপর আমাকে দেখে আশেপাশের অনেকেই ফ্রিল্যান্সিংয়ের প্রতি আগ্রহী হয়। সেই থেকে নিজে কাজ করছি এবং অন্যকেও শেখানো শুরু করি। এতে নিজের উপার্জন সক্ষমতাও যেমন তৈরি হচ্ছে, তেমনিভাবে দক্ষ জনবল তৈরি হচ্ছে।”
হামিদুর রহমান বলেন, “আমাদের সঙ্গে টানা দুই মাস রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা কোর্স করতে হবে। ফিজিক্যালি কোর্সে রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসস্থান। থাকাটা আমাদের, কিন্তু খাওয়া নিজের। সেই ক্ষেত্রে মাসিক তিন থেকে চার হাজার টাকা হলেই হয়ে যাবে। এভাবেই দুই মাস আমাদের সঙ্গে রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা কাজ করে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কোর্স সম্পন্ন করতে পারে যে কেউ। আমার ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে প্রায় ১৭ হাজার মানুষকে ফ্রিতে ফ্রিল্যান্সিং সাপোর্ট দিচ্ছি এবং ৫ হাজার স্টুডেন্টকে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ শেখাতে পেরেছি। আমার ফ্রিল্যান্সিং ইনস্টিটিউট বিডি-এর স্টুডেন্টরা আজ ৫০০ ডলার থেকে এক হাজার ডলারের কাজ পাচ্ছে। আবার অনেকেই আছে মাসে লাখ টাকা ইনকাম করছেন।”
তিনি আরও বলেন, “আমার ফ্রিল্যান্সিং ইনস্টিটিউট বিডি থেকে সফলভাবে ফ্রিল্যান্সিং ট্রেনিং করে যারা ভাল করেছে এবং খুব আগ্রহী তাদের নিয়ে আমি আমার টিম তৈরি করেছি। আমার টিমে ২২ জন আছে। এই টিমে তিনজন এক্সিকিউটিভ রয়েছেন। যারা মূলত সম্পূর্ণ টিমটির নেতৃত্ব দেন।”
ফ্রিল্যান্সার হামিদুর রহমান এখন শুধু ফ্রিল্যান্সিং করছেন না। আর্তমানবতার সেবায়ও এগিয়ে আসছেন। বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি দেশের যেকোনো খারাপ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দুর্যোগ মোকাবিলায় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে থাকার চেষ্টা করছেন। গত বন্যায় সিলেটে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ৭ হাজার পরিবারের জন্য খাবার নিয়ে সিলেটে ছুটে যান। তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাবার পৌঁছে দেন।
হামিদুর রহমান আরও বলেন, “আমি যেহেতু ফ্রিল্যান্সিং করছি এবং ফ্রিল্যান্সিং ইনস্টিটিউট বিডির মাধ্যমে হাজারো তরুণকে ফ্রিল্যান্সিং শেখাচ্ছি, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে আমি আমার প্রতিষ্ঠানকে একটি ভাল অবস্থানে নিয়ে যাব এবং হাজারো তরুণ বেকারকে ফ্রিল্যান্সিং শিখিয়ে কর্মমুখী করে গড়ে তুলব। আমার নিজের একটি আইটি ফার্ম করার ইচ্ছা রয়েছে। যার মাধ্যমে আমরা বিদেশি ক্লায়েন্টদের বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল মার্কেটিং সার্ভিস প্রদান করব।”
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহীন উদ্দিন বলেন, “বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সারের দিকে অনেকটাই এগিয়েছে। শিক্ষিত যুবসমাজের ফ্রিল্যান্সিংয়ের প্রতি আগ্রহ থাকায় এবং বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী ইন্টারনেট সেবা শহর ছাড়িয়ে গ্রাম পর্যায়ে চলে যাওয়ায় এটা সম্ভব হয়েছে। এটি আরও এগিয়ে নিতে দক্ষ প্রশিক্ষক তৈরির প্রতি সরকারের জোর দেওয়া উচিত বলে মনে করছি।”