লক্ষ্মীপুরে বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। তবে তুলনামূলক ধীরগতিতে পানি নামছে বন্যাকবলিত এলাকা থেকে। এর কারণ হিসেবে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ নির্মাণ ও বিভিন্ন এলাকায় নদী খাল দখল হয়ে যাওয়াকে দায়ী করেছেন বানভাসিরা।
গত ১৫ দিনেরও বেশি সময় ধরে জেলার লাখ-লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছেন। গত ৪-৫ দিনে জেলার কিছু স্থানে দুই থেকে আড়াই ফুট পানি নামলেও অনেক স্থানে এখনো হাটু, বুক ও কোমর পানি রয়ে গছে।
এছাড়া বন্যার পানিতে এখনো তলিয়ে রয়েছে জেলার ৫৮টি ইউনিয়ন ও চারটি পৌরসভার বেশির ভাগ এলাকা। স্মরণকালের এ বন্যায় লক্ষ্মীপুর জেলার ৯০ শতাংশ এলাকাই পানির নিচে তলিয়ে গেছে। প্রায় ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দী ছিলেন। তবে তা এখন কমে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, লক্ষ্মীপুরে ছোট-বড় প্রায় ১১০টি নদী-খাল রয়েছে। এসব নদী-খালে প্রায় আড়াই হাজার বাঁধ রয়েছে। বেশির ভাগ বাঁধ অবৈধভাবে দিয়ে মাছ চাষ করেছেন একদল প্রভাবশালী। যার কারণে বন্যা বা জলাবদ্ধতার পানি চলাচল ব্যাহত হয়। বিশেষ করে ডাকাতিয়া ও ভূলুয়া নদী, রহমতখালী ও বিরোন্দ্র খাল পানি নিষ্কাশনের অন্যতম পথ।
প্রায় ২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদী বা খাল মিশেছে মেঘনা নদীতে। এই চারটি নদী ও খালের আশপাশের পানি কমেছে দুই থেকে আড়াই ফুট। এছাড়া এখনো তলিয়ে আছে বেশির ভাগ রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়ি।
জানা যায়, লক্ষ্মীপুর অংশের উপকূলীয় অঞ্চলকে বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করতে প্রায় পাঁচ যুগ আগে মেঘনা নদীর পাশে নির্মাণ করা হয় ৩৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। এই বেড়িবাঁধের আশপাশে রয়েছে ঘরবাড়ি ও জেগে ওঠা কয়েক হাজার একর ফসলি জমি। গত চার দশকে সেই এলাকা দখল কিংবা ইজারা নিয়ে তৈরি করা হয় মাছের ঘের ও পুকুর। আর খালের ওপর বাঁধ তৈরি করে মাছ চাষ করছেন প্রভাবশালীরা। এতে বাঁধা হয়েছে পানি চলাচলের পথ।
এদিকে বন্যার পরে ৪-৫ দিন ধরে পানি নামতে শুরু করলেও তেমন উন্নতি হয়নি পরিস্থিতির। দুর্ভোগ কাটেনি বানভাসিদের। পানিবন্দী মানুষের দিন কাটছে অর্ধহারে-অনাহারে। কবে নাগাদ বন্যার উন্নতি হয়ে স্বাভাবিক হবে জনজীবন, সেটাও নিশ্চিত নয় বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
সদর উপজেলার বাসিন্দা হুমায়ুন কবির, তোফায়েল আহমেদ, বাহার উদ্দিন ও পৌর শহরের বাসিন্দা আবদুর রহমান, আলমগীর, ইব্রাহিম বলেন, “এবারের মতো বন্যা এর আগে দেখা যায়নি। বৃষ্টি না থাকলেও পানি নামছে ধীরগতিতে। এতে চরম দুর্ভোগে বানভাসি মানুষ। দুই দিনে ৫-৬ ইঞ্চি পানি কমছে। অভিযোগ রয়েছে, অবৈধভাবে প্রভাবশালীরা ডাকাতি ও রহমতখালী খালসহ বিভিন্ন খালে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করার কারণে পানি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। যার কারণে বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে মানুষের ভোগান্তি বাড়ে কয়েকগুন।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুর রহমান বলেন, “বন্যার শুরু থেকে অবৈধ বাঁধ অপসারণের উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। ইতোমধ্যে দুই শতাধিক স্থানে খালের ওপর বাঁধ কেটে দেওয়া হয়েছে। ফলে অল্প সময়ের মধ্যে বন্যার অবস্থা স্বাভাবিক হবে বলে আশা করা হচ্ছে।” এছাড়া অবৈধ বাঁধ অপসারণের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ডাকাতিয়া ও ভুলুয়া নদী, রহমতখালী এবং বিরোন্দ্রখাল জেলার পানি নিষ্কাশনের অন্যতম পথ। এই খালগুলো বর্তমানে দখল হয়েছে। কোথাও কোথাও হয়েছে দূষণ। খালের ওপর বাঁধ রয়েছে কোথাও কোথাও। এতে করে পানি নামতে পারছেনা। অবৈধভাবে প্রভাবশালীরা ডাকাতিয়া, রহমতখালী খালসহ বিভিন্ন খালে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করায় পানি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। ফলে দ্রুত পানি সরছে না।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ-উজ-জামান বলেন, “বন্যার পানি কমছে, তবে ধীরগতিতে। জেলায় ১১০টি ছোট-বড় নদী-খাল রয়েছে। এইসব নদী-খালে প্রায় আড়াই হাজারের বেশি অবৈধভাবে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে। এ ছাড়া কয়েক হাজার বহুতল ভবন অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে। ভুলুয়া ও রহমতখালী নদীসহ খালগুলো দখলে সংকুচিত হয়ে গেছে। এ কারণে পানি নামতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৫০টি বাঁধ কেটে দেওয়া হয়েছে। অবৈধভাবে দখল করা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হবে।”