• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বন্যায় ফসল নষ্ট : নতুন আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় চাষিরা


কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২, ২০২৪, ০৪:৫৭ পিএম
বন্যায় ফসল নষ্ট : নতুন আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় চাষিরা

‘মোর ৫ বিঘা জমি, পটোল আবাদ করছিলং, এবারের ২ ধাপে বন্যায় সোগ নষ্ট হয়া গেইছে। এল্যাউ জমিত নয়া ফসল গাড়বের পাং নাই। সরকারে বীজ দিবার চাইছে এল্যাউ দেয় নাই।’

কথাগুলো বলছিলেন কুড়িগ্রাম সদরের পাঁচগাছি ইউনিয়নের ছড়ার পাড় গ্রামের কৃষক সাইদুল ইসলাম। তিনি তার জমিতে মরিচ ও পটলের আবাদ করেছিলেন। কিন্তু চলতি বছরের দু’দফা বন্যায় তার ৫ বিঘা জমির প্রায় ৭ লাখ টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে।

তার মতো জেলার প্রায় ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ হাজার কৃষক এখনো বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। সরকারি প্রনোদনার আশায় তারা দিন গুনছেন। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সরকারি সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস মিললেও বিভিন্ন কারণে সে প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। শেষ পর্যন্ত সহায়তা না পেলে সংকটে পড়ার কথা জানান ভুক্তভোগী কৃষকরা।

জানা যায়, চলতি বছরের এপ্রিল ও মে মাসে কুড়িগ্রামে তেমন বৃষ্টি হয়নি। ছিল খড়া। এরপর পুরো জুন মাস ধরে অতিবৃষ্টি হয়েছে। যার পরিমাণ ১ হাজার ১০০ মিলিমিটার বলে জানিয়েছে জেলার কৃষি আবহাওয়া অফিস। এরপর জুলাইয়ের প্রথম থেকে শুরু হয়েছিল বন্যা। টানা প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এসব কৃষক পুঁজি ও সহায় সম্বল হারিয়ে নতুন করে ফসল উৎপাদন করতে পারছেন না জেলার অনেক কৃষক।

কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বন্যায় জেলার ৯ উপজেলায় ৮ হাজার হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল নষ্ট হয়েছে। এতে ক্ষতি হয়েছে ১০৫ কোটি টাকা। আর ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার।

রোববার (১ সেপ্টেম্বর) সরেজমিনে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি ফসলের ক্ষেত ঘুরে দেখা যায়, জেলার দুই দফা বন্যায় কৃষকদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষেতগুলোতে মরিচ, পাট, শশা, কাউন, পটল, ঝিঙ্গাসহ অনেক ফসলের গাছ নষ্ট হয়ে শুকিয়ে পড়ে আছে। ক্ষেতের চারপাশের ঘেরা দেওয়া বাঁশের তৈরি বেড়াগুলো এলোমেলো ভেঙে পড়ে আছে।

কেউ কেউ কয়েকটি জমিতে আমন বীজতলা রোপন করলেও অধিকাংশ জমি অনাবাদিই পড়ে আছে। নতুন ফসল উৎপাদনে অনাগ্রহ দেখা দিয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত চাষীদের মাঝে। অনেকে ঋণ করে বীজ বপন করে বন্যায় হারিয়েছেন সব পুঁজি। অনেকের জমানো বীজ ফসলে রোপন করে ক্ষতির শিকার হয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন।

এমতাবস্থায় ক্ষতিগ্রস্তরা এখন বীজ, সার ও কীটনাশকের অভাবে নতুন করে ফসল উৎপাদন করতে পারছেন না। আশায় আছেন সরকারিভাবে প্রণোদনা পেলে নতুন করে আবার ফসল উৎপাদন শুরু করবেন।

কৃষকরা জানান, প্রতি বিঘায় সার ও বীজ বাবদ ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়। এর বিপরীতে প্রতি বিঘায় ২৫-৩০ মণ ফসল বিক্রি করে লাভ হতো ৮০-৯০ হাজার টাকা।

পাঁচগাছী ইউনিয়নের কলেজ মোড় এলাকার কৃষক ফারুক হোসেন বলেন, “বন্যায় আমার এখানকার বীজতলা নষ্ট হয়ে গেছে। উঁচু এলাকায় চড়া দামে বীজতলা বিক্রি করছে। এখন চড়া দামে জমিতে যদি বীজতলা রোপণ করি, যদি আবার বন্যা হয় তাহলে কী হবে আমার। এর আগে তো আমার বিভিন্ন সবজি পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে।”

একই গ্রামের শামসুল আলম নামের আরেক কৃষক সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “আমি ৪ বিঘায় মরিচ আর শষা আবাদ করেছিলাম। বন্যায় সোগ শেষ। এক মাস ধরে কামলা দিয়ে চলছি। এখনো নতুন করে চাষাবাদের কাম শুরু করতে পারি নাই। জমির মধ্যে সব ফসল নষ্ট হয়া পড়ি আছে।”

যাত্রাপুর ইউনিয়নের ধরলার পাড়ের কৃষক মো. রব্বানী বলেন, “আমি দুই বিঘা জমিতে পাটের আবাদ করেছি। আর অল্প কিছুদিনের মধ্যে পাট কাটা হতো। এর মধ্যে বন্যায় পাট তলিয়ে সব গাছ মরে গেছে। এখন খড়ি করা ছাড়া কোনো উপায় নাই। তাই পাট কেটে খড়ির জন্য শুকাচ্ছি। সরকার থেকে এখনো কোনো সাহায্য পাই নাই।”

যাত্রাপুর ইউনিয়নের কৃষক মমিন মিয়া বলেন, “আমার জমি ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার নিচু অঞ্চলে হওয়ায় বন্যার পানিতে বীজতলাসহ সব নষ্ট হয়ে গেছে। হাতে টাকা-পয়সাও নাই। হালচাষ, সার খরচ ও চারা কেনার মতো টাকাও নাই। ঋণ করে আমন চারা রোপণ করা ছাড়া উপায়ও নাই। আর কয়েকদিন অপেক্ষার পর যেভাবেই হোক জমিতে চারা রোপণের চিন্তা করছি।”

সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “এ ইউনিয়নের প্রায় পুরোটাই চরাঞ্চল। প্রায় সব কৃষকই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বন্যা-পরবর্তী সময়ে এখানে বীজসহ সার কীটনাশক দিয়ে সহায়তা করা প্রয়োজন। সরকারি সহায়তা না পেলে তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।”

কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা ড. মো. মামুনুর রহমান সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “জেলার দুই দফাই ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের তালিকা করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। এখনো বরাদ্দ মেলেনি। সরকারি প্রণোদনা পাওয়ামাত্রই তা কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হবে।”

Link copied!