ফেনীতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্ষতচিহ্ন। ভারত থেকে নেমে আসা উজানের ঢলে তীব্র স্রোতে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়। এতে দিশেহারা হয়ে ঘরবাড়ি ফেলে প্রাণে বাঁচতে মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছে। জেলার সবকটি উপজেলাতেই ভয়াবহ রূপ। নিয়েছে আকস্মিক এই বন্যা।
এতে অসংখ্য বসতঘর, গ্রামীণ সড়ক, ফসলি জমি ও ছোট-বড় পুকুর তলিয়ে কৃষি ও মৎস্য খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, ছয় উপজেলায় পানিবন্দী মানুষের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। তবে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে।
বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর খেতে মাচান থাকলেও নেই সবুজ গাছ। পানির নিচ থেকে ভেসে উঠছে হলুদ, আদা, আউশ, আমন ও শীতকালীন আগাম বিভিন্ন সবজি খেত। দেড় মাসের ব্যবধানে তৃতীয় দফায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় জেলার ছয়টি উপজেলায় শুধুমাত্র কৃষিতেই ক্ষতি হয়েছে ৪৫১ কোটি ২০ লাখ টাকার বেশি। এতে প্রায় দুই লক্ষাধিক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
এদিকে বন্যায় জেলার অধিকাংশ পুকুর ও ঘেরের মাছ পানিতে ভেসে গেছে। বন্যায় মৎস্য খাতে রেণু, পোনা, বড় মাছ ও পুকুরের অবকাঠামোগত ক্ষতিসাধিত হয়েছে।
জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েকদিনে জেলার ছয়টি উপজেলায় বন্যায় মাছ চাষিদের ২৮ কোটি ৯ লাখ ২০ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এ সংশ্লিট অন্তত ২০ হাজার মানুষ। বন্যার পানিতে ভেসে গেছে একক ও যৌথ মালিকানারীণ ১৮ হাজার ৭৬০টি পুকুর-দিঘি। এসব পুকুর থেকে ২২ কোটি ৬৪ লাখ টাকার বড় মাছ এবং ১৯৭ লাখ টাকার মাছের পোনা ভেসে গেছে। এছাড়া জেলায় খামারিদের ৫৪ লাখ টাকার অবকাঠামো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় জেলার ৩০ হাজার ৩৫২ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যা মোট ফসলি জমির ৭৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। তারমধ্যে ১ হাজার ৮৬৫ হেক্টর আমন বীজতলা, ২৬ হাজার হেক্টর আমন, ১ হাজার ৮৫৪ হেক্টর আউশ, আবাদকৃত ৫২৫ হেক্টর শরৎকালীন সবজির পুরো অংশ, ৬৯ হেক্টর ফলবাগান, ৭ হেক্টর আদা, ১৬ হেক্টর হলুদ এবং ১৬ হেক্টর আখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পরশুরামের কাউতলি গ্রামের কৃষক আলী আহম্মদ বলেন, বছরের প্রথম দফায় বন্যায় আমন বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারপর আবার বীজ বপন করে আমন আবাদের কিছুদিন পর বন্যার পানিতে সব ভেসে যায়। দেড় মাসের ব্যবধানে তৃতীয় দফার বন্যায় সবগুলো ফসলি জমি এখন বালুর স্তুপ হয়ে আছে। কোনভাবে আবাদ করে খাবো এমন পরিস্থিতি আর নেই।
সাইদুল ইসলাম নামে আরেক কৃষক বলেন, ভয়াবহ খাদ্য সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছি আমরা। জমির ফসল নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি ঘরে থাকা ধান-চালও পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। নতুন করে আবাদ করার মতো কোন পরিস্থিতি নেই। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি আমাদের পাশে না দাঁড়ায় তাহলে ভবিষ্যত পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
বীরচন্দ্রনগর এলাকার মৎস্য খামারি মো. দুলাল বলেন, নদীর পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুকুরের চারপাশে যেটি জাল দিয়ে ঘিরে রেখেছিলাম। কিন্তু ভয়াবহ বন্যা সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. একরাম উদ্দিন বলেন, বন্যায় কৃষিতে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। আমাদের জেলা কার্যালয়ও বুক পানিতে নিমজ্জিত ছিল। তারপরেও আমরা মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ এবং তাদের নানা পরামর্শের মাধ্যমে পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। কৃষকদের আমনের চারা দেওয়ার ব্যাপারে দাপ্তরিকভাবে একটি কথা উঠে এসেছে। এ ছাড়া এ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে আগাম জাতের কিছু ফসল আবাদের বিষয়ে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম জানান, মৎস্যখাতে ২৮ কোটি ৯ লাখ ২০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে।