সুপেয় পানি, চিকিৎসা, নিরাপত্তাসহ নানা সমস্যায় সুন্দরবনের দুবলার চরের শুঁটকি পল্লির প্রায় ২৫ হাজার জেলে। বন বিভাগের আশ্বাসের ওপর নির্ভর করে বছরের পর বছর কেটে গেলেও আজও মেলেনি কাঙ্ক্ষিত সেবা। পানির চাহিদা মেটাতে বাধ্য হয়ে খেতে হয় কুয়ার পানি।
সরেজমিন ও বাগেরহাট পূর্ব বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বঙ্গোপসাগরসংলগ্ন সুন্দরবনের দুবলার চর, আলোর কোল, শ্যালার চর, নোরকেলবাড়িয়া, মাঝের কেল্লা, অফিসকেল্লাসহ কয়েকটি চরে প্রতিবছর নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ৫ মাস চলে শুঁটকি আহরণ মৌসুম। সুন্দরবনে শুঁটকি আহরণ মৌসুমে এসব চরে বাঁশ, কাঠ, ছন ও পলিথিন দিয়ে ছাপরা ঘর তৈরি বসবাস করেন ১০ হাজার ছেলে। অবশ্য জেলেদের দাবি, প্রতিবছর শুঁটকি মৌসুমে কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ হাজার জেলে অবস্থান করেন সুন্দরবনের চরগুলোতে।
বন বিভাগের তথ্যমতে, গত অর্থবছরে জেলে ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৪ কোটি ১৮ লাখ টাকা। এ বছর সাড়ে ৪ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বন বিভাগ।
জেলেদের অভিযোগ, বছরের এই ৫ মাস জীবিকার তাগিদে মৎস্য আহরণ কাজে নিয়োজিত জেলেদের খাবার পানির অভাব, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা, ঝড় জলোচ্ছ্বাস ও নিরাপত্তাসহ নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় প্রতিনিয়ত। খাবার পানির অভাবে নানা রোগে আক্রান্ত হলেও মেলে না চিকিৎসা সেবা। এছাড়া ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচতে নেই পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র। আশ্বাসের ওপর নির্ভর করে কেটে যাচ্ছে বছরের পর বছর। তবু মিলছে না সুপেয় পানি, আশ্রয়কেন্দ্র ও চিকিৎসাসেবা।
খুলনার পাইকগাছা উপজেলার বাসিন্দা শুঁটকি ব্যবসায়ী মুজিবর রহমান বলেন, “জীবিকার তাগিদে আমি ৪৭ বছর ধরে সুন্দরবনের এই শুঁটকি পল্লিতে মাছ আহরণ ও প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে যুক্ত। বন বিভাগকে রাজস্ব দিয়ে আমাদের এখানে আসতে হয়। তবু এখানকার জেলে ও ব্যবসায়ীদের খাবার পানি, চিকিৎসা সেবাসহ নানা সমস্যায় পড়তে হয়।”
একই উপজেলার জেলে তপন দাস বলেন, “খাবার পানি বলতে আমাদের এখানে দুটি পুকুর ও ১৩টি পানির কুয়া রয়েছে। এই কুয়াগুলোর মধ্যে ১০টি কুয়ার পানি ব্যবহারের অনুপযোগী। তিনটি কুয়া থেকে আমরা পানি সংগ্রহ করি। যে ৫টি সাইক্লোন সেল্টার আছে তা পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে অনেক আগেই।”
বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার বাসিন্দা জেলে জামাল মোল্লা বলেন, “সুন্দরবনের এই চরগুলোতে চট্টগ্রাম, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা, বরগুনা, বাগেরহাট ও খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার জেলেরা আসেন। সরকারও এখান থেকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করে। কিন্তু সেই তুলনায় আমরা তেমন কোনো সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাই না।”
দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের সভাপতি কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, “দেশের শুঁটকি চাহিদার ৮০ ভাগ আসে দুবলা থেকে। এই শুঁটকি মৌসুম ঘিরে এখানে প্রায় ২৫ হাজার জেলে অবস্থান করেন। এখান থেকেই বন বিভাগ কোটি কোটি টাকার রাজস্ব পায়। কিন্তু কোটি টাকা রাজস্ব দিলেও বন বিভাগের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা পায় না জেলেরা। এদিকে গত বছরের তুলনায় এ বছর বন বিভাগ রাজস্ব নির্ধারণ দ্বিগুণ করেছে।”
অতিরিক্ত আইজি ও নৌ পুলিশ প্রধান মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, “সুন্দরবন ও জেলেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দুবলার চরের আলোরকোলে একটি নৌ পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হবে। ইতিমধ্যে জায়গা নির্ধারণ করতে জেলে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আমাদের মতবিনিময় হয়েছে। আশা করছি দ্রুত জায়গা নির্ধারণ আমরা কাজ শুরু করতে পারবো।”
বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, “যেহেতু জেলেরা আমাদের রাজস্ব দিচ্ছেন, ৫ মাস সেখানে অবস্থান করছেন, সেখানে তাদের সুপেয় পানি, চিকিৎসা সেবা ও আশ্রয় কেন্দ্রের প্রয়োজন আছে। আমাদের একটি ইকো-ট্যুরিজম প্রকল্প আছে, ওই প্রকল্পের আওতায় দুবলার জেলেদের পানির চাহিদা মেটানোর জন্য একটি নতুন পুকুর খনন করে দিয়েছি। এছাড়া একটি পুরাতন পুকুর ছিল সেটা সংস্কার করে দেওয়া হয়েছে। এতে যদি জেলেদের পানির চাহিদা পূরণ না হয়, সে ক্ষেত্রে আমাদের সুরক্ষা প্রকল্প নামে আরও একটি প্রকল্প আছে, ওই প্রকল্পের আওতায় আমরা সেখানে আরও ১টি পুকুর খনন করে দেবো।”
মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন আরও বলেন, “আমরা সেখানে একটি ভাসমান হাসপাতাল তৈরির জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। পাশাপাশি সেখানে ডাক্তারের ব্যবস্থা করার জন্য বাগেরহাট সিভিল সার্জনকে অবহিত করা হয়েছে।”