মেহেরপুরে হয়ে গেল গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলা। জেলার গাংনী উপজেলার চর গোয়াল গ্রামে এই আয়োজন দেখতে ভিড় জমান দূর-দূরান্ত থেকে আসা দর্শকেরা। নারী সদস্যদের লাঠি খেলা ছিল আয়োজনের মূল আকর্ষণ। দর্শকের সমাগমে এলাকাটি যেন পরিণত হয় জনসমাবেশে। তরুণ প্রজন্মকে লাঠি খেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত ও মাদকাসক্ত দূর করতে এ আয়োজন করা হয়েছে বলে জানান আয়োজকেরা।
শনিবার (৭ জানুয়ারি) দিনব্যাপী আয়োজনে লাঠি খেলার বিভিন্ন কৌশল প্রদর্শন করেন লাঠিয়াল বাহিনী। খেলা শেষে রাতে বিজয়ীদের মাঝে পুরষ্কার তুলে দেওয়া হয়।
লাঠি খেলা, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলার মধ্যে অন্যতম। মানুষের প্রয়োজন থেকে উদ্ভব হয় এ খেলাটি। একসময় ছিল জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। মনের খোরাক মেটাতে এখনো এই খেলার কদর কমেনি সাধারণ মানুষের কাছে। তারই প্রমাণ মিলল মেহেরপুর গাংনী উপজেলার চর গোয়োল গ্রামে।
হাজারো দর্শকের মাঝে লাঠি খেলার বিভিন্ন কৌশল ও শারীরিক কসরত দেখান দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা লাঠিয়াল বাহিনী। আত্মরক্ষা ও শারীরিক ভারসাম্য রক্ষায় লাঠি খেলার গুরুত্ব দেখানো হয় এই প্রদর্শনে। অন্যান্য খেলার মতোই লাঠি খেলাতে রয়েছে আনন্দ। একত্রে সামনের বিপদকে মোকাবিলা করার দীক্ষাও রয়েছে এই খেলায়।
এবারের আয়োজনের মূল আকর্ষণ ছিল নারী লাঠিয়ালের প্রদর্শন। পুরুষের পাশাপাশি নারী সদস্যরাও লাঠি খেলায় পারদর্শি হতে পারে তার দৃষ্টান্ত দেখানো হয়। খেলাটিকে স্বীকৃতি দিতে ফেডারেশন তৈরি ও নারীদের আগ্রহী করতে সরকারি পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি করেন খেলোয়ারেরা।
কুষ্টিয়া থেকে আগত নারী লাঠিয়াল শাহনাজ সুলতানা দিজু বলেন, “নারীদের শুধু খেলা নয়, আত্মরক্ষার জন্যও লাঠি খেলা অন্যতম অনুষঙ্গ হতে পারে। এছাড়া শারীরিক কসরত ভালো হয় লাঠি খেলা অনুশীলনের মাধ্যমে। নতুন প্রজন্মের মাঝে এই খেলা ছড়িয়ে দিতে পারলে নতুন নতুন খেলোয়াড় তৈরি হবে। আবারও পুরো দমে লাঠি খেলার যৌলুস ফিরে আসবে বলে আমি মনে করি।”
আরেক খেলোয়ার বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনীর সদস্য রুপন্তী চৌধুরী বলেন, “লাঠি খেলা শুধু পুরুষদের নয়, এটি নারীদের জন্যেও। নারীদের এগিয়ে নিয়ে আসার জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তাহলে নারী খেলোয়াড় তৈরি হবে।”
দেবীপুর লাঠিয়াল বাহিনীর সরদার মোজাম্মেল হোসেন বলেন, “ফুটবল ক্রিকেটের পাশাপাশি লাঠি খেলায় রয়েছে আনন্দ। ঠিকমতো কৌশল রক্ত করতে পারলে এটি শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক থেকে আনন্দদায়ক। আমাদের গ্রামের বিভিন্ন বয়সের তরুণ ও সাধারণ মানুষকে নিয়ে তৈরি করেছি লাঠিয়াল বাহিনী। এই খেলায় আমার লাঠিয়াল বাহিনীও খেলা প্রদর্শন করছে। আমাদের খুব ভালো লাগছে। নিয়মিত এমন আয়োজন ও লাঠিয়াল বাহিনীদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হলে এই খেলা আবারও নবরূপে ফিরে আসবে।”
খেলা দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে ভিড় জমায় সাধারণ মানুষ। পুরুষের পাশাপাশি নারী দর্শকের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
খেলা দেখতে আসা হামিদুর রহমান বলেন, “লাঠি খেলা দেখে আমরা অনেক আনন্দিত। আমাদের বয়সের অনেকেই এই খেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত তা এখানে এসে দেখছি। ভবিষ্যতে আমিও কোনো লাঠিয়াল বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে কৌশল রপ্ত করার চেষ্টা করব।”
আরেক দর্শক মিথিলা বলেন, “আগে আমি কখনো নারীদের লাঠি খেলা দেখিনি, আজ নারীদের লাঠি খেলা দেখে আমি আনন্দিত, খুব ভালো লাগছে।”
খেলা দেখতে এসেছিলেন প্রবীন অনেক দর্শক। কথা হয় এমন কয়েকজনের সঙ্গে। তারা বলছেন, “লাঠি খেলার দেখার পর থেকে ছোটবেলার সেই স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এক সময় আমরাও লাঠি খেলা খেলেছি। কিন্তু এখন বয়স হয়ে যাওয়ায় আর খেলতে পারি না। এখন এই খেলা দেখে অনেক ভালো লাগছে।”
আয়োজক কমিটির সদস্য তৌকির আহমেদ বলেন, “আমাদের সহযোগিতায় এলাকার বিখ্যাত লাঠিয়াল মৃত জৌলুস সরদারের স্মরণে প্রতিবছরই লাঠি খেলার আয়োজন করে গ্রামবাসী। এবার খেলায় মোট ছয়টি লাঠিয়াল দল অংশগ্রহণ করেছে। কুষ্টিয়া থেকে তিনটা লাঠিয়াল বাহিনী ও আমাদের জেলার তিনটা লাঠিয়াল বাহিনী তাদের লাঠি খেলা প্রদর্শন করে। খেলা শেষে প্রত্যেকটি দলকে একটি করে ছাগল উপহার দেওয়া হয়েছে।”