কক্সবাজারের রেল যোগাযোগ স্থাপন ছিল স্বপ্ন। শনিবার (১১ নভেম্বর) এ স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি স্বপ্নের এ রেলপথ উদ্বোধন করবেন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী আরও ১৬টি প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার কথা রয়েছে।
সৈকত পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারিত হওয়ায় জেলায় উৎপাদিত পণ্য কম মূল্যে যেমন পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি হবে, তেমনি পর্যটক আগমনও বেড়ে যাবে কয়েক গুণ। তবে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
কক্সবাজারের রেল যোগাযোগের মধ্য দিয়ে পর্যটনে সুবাতাস বয়ে আনার পাশাপাশি বহুমাত্রিক অর্থনীতির জানালা খুলে যাবে। এতে বিনিয়োগ বাড়বে পর্যটন, কৃষি ও চিংড়ি শিল্পে। গতি পাবে এ অঞ্চলের অর্থনীতির চাকা। এ কারণে আনন্দে উচ্ছ্বসিত কক্সবাজারের মানুষ।
জানা যায়, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কপথের দূরত্ব প্রায় ১৫০ কিলোমিটার। সড়কপথে বাসে যেতে সময় লাগে পাঁচ ঘণ্টা। আর এ মহাসড়কে যানজটে পড়লে পেরিয়ে যায় ছয়-সাত ঘণ্টা। এ রেলপথ চালু হলে ছয়-সাত ঘণ্টার এ দূরত্ব নেমে আসবে অর্ধেকে; কমবে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকিও। আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আসার পাশাপাশি সুযোগ সৃষ্টি হবে বহুমাত্রিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কক্সবাজার শহর থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বে ঝিলংজা ইউনিয়নের হাজীপাড়া এলাকায় ২৯ একর জমির ওপর ২১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে আইকনিক রেলস্টেশন। ঝিনুকের আদলে তৈরি দৃষ্টিনন্দন এ স্টেশন ভবনটির আয়তন ১ লাখ ৮২ হাজার বর্গফুট। ছয়তলা ভবনটির কাজ প্রায় শেষ। ঝিনুকের আদলে তৈরি স্টেশনটিতে আবাসিক হোটেলের পাশাপাশি ক্যান্টিন, লকার, গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। পর্যটকরা স্টেশনের লকারে লাগেজ রেখে সারাদিন সমুদ্রসৈকতে বা দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে পারবেন। এ স্টেশন দিয়ে দিনে ৪৬ হাজার মানুষ আসা-যাওয়া করতে পারবে।
প্রকল্প পরিচালক সুবক্তগীন জানান, স্টেশনটি নির্মাণে চীন, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, ইতালিসহ বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক স্টেশনের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। পুরো প্রকল্পটিতে ১১০ বিদেশিসহ মোট ২৫০ প্রকৌশলী এবং ছয় শতাধিক লোক কাজ করছে। চার বছরের শ্রমে আইকনিক রেলস্টেশন ভবনটি আজ দৃশ্যমান। এখন সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ চলছে।
তিনি বলেন, এটি হবে এশিয়ার প্রথম শতভাগ পর্যটনবান্ধব কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছয়তলার স্টেশন। এতে রয়েছে পর্যটকের জন্য সব সুযোগ-সুবিধা। থাকছে আধুনিক ট্রাফিক সুবিধা। স্টেশনের নিচতলায় থাকছে টিকিট কাউন্টার, অভ্যর্থনা কেন্দ্র। দ্বিতীয় তলায় শপিংমল ও রেস্তোরাঁ। তিনতলায় থাকবে তারকা মানের হোটেল। থাকছে মসজিদ, শিশু যত্ন কেন্দ্র, এটিএম বুথ, পোস্ট অফিস, ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন বুথসহ নানা সেবাকেন্দ্র।
কক্সবাজার সিটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের পর্যটন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মঈনুল হাসান পলাশ বলেন, ‘সস্তায় আসা যাওয়া-সস্তায় থাকা খাওয়া’– এটি পর্যটন বিকাশের মন্ত্র। এখন সড়কপথে কক্সবাজারে আসতে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। রেল চালু হলে যাতায়াত আরও সহজ হবে।
কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, সমুদ্রসৈকত দেখার জন্য প্রতিবছর অন্তত ১৬ লাখ পর্যটক কক্সবাজার আসেন। রেলপথ চালু হলে এর সংখ্যা তিন গুণ বেড়ে যাবে। তখন পর্যটন খাতে উন্নতির পাশাপাশি রেল খাতেও সরকারের কোটি কোটি টাকা আয় হবে।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, রেল চালু হলে পর্যটক যাতায়াত সহজ হওয়ার পাশাপাশি স্বল্প সময়ে ও কম খরচে কৃষিপণ্য, মাছ, লবণ পরিবহন করা যাবে। এতে কক্সবাজারের পর্যটনসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে আসবে বৈপ্লবিক বদল।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শুরুতে এটি ছিল ‘দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ’ প্রকল্প। এতে মোট ১২৯ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের কথা ছিল। পরে রামু থেকে ঘুমধুম অংশের কাজ স্থগিত করা হয়। এখন চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।
মোট ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকার এ প্রকল্পে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে। বাকি ৪ হাজার ১১৯ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে।
প্রকল্পের জন্য কক্সবাজারে ১ হাজার ৩৬৫ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হয়েছে ৯টি রেলওয়ে স্টেশন, চারটি বড় ও ৪৭টি ছোট সেতু, ১৪৯টি বক্স কালভার্ট এবং ৫২টি রাউন্ড কালভার্ট।
২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর ২৯ প্রকল্পের উদ্বোধনের ১১ মাসের মাথায় আগামীকাল শনিবার সকালে রেল মন্ত্রণালয়ের অধিনে কক্সবাজার সদর উপজেলার ঝিলংজা চান্দেরপাড়া এলাকায় নির্মিত আইকনিক রেলস্টেশনের উদ্বোধন করবেন তিনি। পরে সুধিজনের সঙ্গে মতবিনিময়ে করে বিকেলে দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে উপজেলা আওয়ামী লীগের জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য দেওয়ার রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর। এ সময় রেললাইন প্রকল্পসহ ১৭টি প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন।
জেলা প্রশাসন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, আইকনিক রেললাইন স্টেশন ও রেল লাইন ছাড়া ১৩টি প্রকল্প উদ্বোধনের জন্য এবং ৩টি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্য ফলক স্থাপন করা হয়েছে। যারমধ্যে উদ্বোধন ও ভিত্তি প্রস্তর যোগ্য প্রকল্পগুলোর মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৭০৭২১.৯৭১৪ কোটি টাকা। তার মধ্যে উদ্বোধনযোগ্য প্রকল্পের ব্যয় ৫২৮৭৮.২৩০১ কোটি টাকা। ভিত্তি প্রস্তরযোগ্য প্রকল্প সমূহের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭৮৪৪.৭২১৩ কোটি টাকা।
যেসব প্রকল্প উদ্বোধন করা হবে
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২৫৯.৯১ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের বাস্তবায়নাধীন কক্সবাজার বিমানবন্দরে উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় বাঁকখালী নদীর কস্তুরা ঘাটে ৫৯৫ মিটার দীর্ঘ পিসি বক্স গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ৪.৯৬ কোটি টাকা ব্যয়ে কুতুবদিয়া উপজেলার কৈয়ারবিল ঠান্ডা চৌকিদারপাড়া ৬০ মিটার আরসিসি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ, ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে চকরিয়া পৌরসভা বাস টার্মিনাল সম্প্রসারণ প্রকল্প, ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৪ এ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের বাস্তবায়নাধীন সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা (বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ) ডিজাইন ও স্থাপনকরণ প্রকল্প। ৩.০৮০৫ কোটি টাকা ব্যয়ে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের আওতায় কক্সবাজার সদর উপজেলা জাহানারা ইসলাম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন নির্মাণ প্রকল্প, মহেশখালীতে ২.৩৮৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে ইউনুসখালী নাছির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন নির্মাণ, ২.৮৫০৪ কোটি টাকা ব্যয়ে উখিয়ায় রত্না পালং আদর্শ উচ্চ বিদ্যাললয়ের একাডেমিক ভবন নির্মাণ, ২.৭৩৯ কোটি টাকা ব্যয়ে মরিচ্যা পালং উচ্চ বিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন নির্মাণ, ৫১,৮৫৪.৮৮ কোটি টাকা ব্যয়ে মহেশখালীতে মাতারবাড়ি ২৬০০ মেগাওয়াট আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র (১ম সংশোধিত) প্রকল্প, ৬৪৭.১২২ কোটি টাকা ব্যয়ে কুতুবদিয়ায় সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে কুতুবদিয়া দ্বীপকে জাতীয় গ্রিডে সংযুক্তকরণ প্রকল্প, ২৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে কক্সবাজার বিমান বন্দর উন্নয়ন (১ম পর্যায়) (৩য় সংশোধিত) প্রকল্পের আওতায় ডিপোজিট ওয়ার্ক হিসেব বাংলাদেশ পানি উন্নয় বোর্ড (বাপাউবো) ২১২ এরক ভূমি ভরাট, ৪.৭৭৪ কিমি ¯েøাপ প্রেটেকশন বাঁধ নির্মাণ, এপ্রোচ রোড়সহ ২টি ব্রিজ ও সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্প এবং ২৫.৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে রামুতে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প।
যেসব প্রকল্পের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করবেন
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের অধীনে টেকনাফে মাল্টিপারপাস ডিজাস্টার রিসিলেন্ট শেল্টার কাম আইসোলেশন সেন্টার নির্মাণ। এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭.০৯ কোটি টাকা। রামুর জোয়ারিনালা ইউপি-মোহসিনা বাজার ভায়া নন্দাখালী সড়কে ১৮৪ মিটার দীর্ঘ আর্চ ও আরসিসি গার্ডার ব্রীজ নির্মাণ প্রকল্প। এটির প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ২৩.৪৯ কোটি টাকা। ১৭ হাজার ৭৭৭.১৬১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে মহেশখালী মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প এবং ১৬.৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ে কক্সবাজার সদর উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে কাব স্কাউটিং সস্প্রসারণ (৪র্থ পর্যায়) প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর সমুদ্র বন্দরের প্রথম টার্মিনাল নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন। সেদিন ৪৬০ মিটার দীর্ঘ কন্টেনার জেটি এবং ১৮ দশমিক ৫ মিটার ড্রফটশ (জাহাজের নীচের অংশ)৩০০ মিটার দীর্ঘ একটি বহুমূখী জেটি এবং একটি কন্টেনার ইয়ার্ডসহ বন্দরের অন্যান্য সুবিধার নির্মাণ কাজ শুরু হবে।এর ফলে আট হাজার থেকে ১০ হাজার কন্টেইনার জাহাজ সরাসরি জেটিতে প্রবেশ করতে পারবে।
সিপিজিসিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে কোম্পানিটি ইতোমধ্যেই মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর চ্যানেলটি সিপিএ চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহেলের কাছে হস্তান্তর করেছে।মাতারবাড়ি বন্দর নির্মাণের জন্য চ্যানেলের প্রস্থ ১০০ মিটার থেকে বাড়িয়ে ৩৫০ মিটার করা হয়েছে।