কুষ্টিয়ায় মামলার এজাহারের কপি তৈরি করে ‘মামলায় আসামি করা হচ্ছে’ জানিয়ে বিভিন্নজনের কাছে ফোন করে চাঁদা দাবি করছে একটি চক্র। টাকা না দিলে যৌথ বাহিনী দিয়ে গ্রেপ্তার করানোর হুমকিও দেওয়া হচ্ছে।
তৈরি করা এজাহারে আওয়ামী লীগের নেতাদের পাশাপাশি শিক্ষক, বেসরকারি চাকরিজীবী ও শহরের ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের আসামির তালিকা করা হচ্ছে। পরে এ তালিকা তাদের মুঠোফোনে পাঠিয়ে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে।
কুষ্টিয়ার ধনাঢ্য দুই ব্যক্তিকে পাঠানো এমন একটি এজাহারের কপি গণমাধ্যমের হাতে এসেছে। এজাহারে বাদীর জায়গায় মাহামুদুল হাসান রোমান নামের এক ব্যক্তির নাম আছে।
জানা যায়, গত ৮ অক্টোবর এজাহারটি বিভিন্ন লোকজনের ফোনে ছড়িয়ে দেয়া হয়। একই ব্যক্তি ৯ অক্টোবর আরও একটি এজাহার তৈরি করেন। সেই এজাহারে আসামি করেন ৬৪ জনকে। সেটিও যারা আসামি হয়েছেন তাদের আত্মীয়-স্বজন ও সংশ্লিষ্টদের মোবাইলে অভিযোগ দিয়ে ভীতি ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। তবে রোমান নামে ওই ব্যক্তি বাদী হয়ে যে দুটি এজাহার তৈরি করেছেন তা এখনো থানায় জমা হয়নি বলে জানায় পুলিশ।
কুষ্টিয়া সদর মডেল থানার জন্য প্রস্তুত করা এজাহারে আসামির তালিকায় আওয়ামী লীগ নেতা, শিক্ষক, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ীসহ মোট ৬০ জনের নাম আছে। সেখানে ৪০ ও ৪১ নম্বরে কুষ্টিয়া শহরের জুগিয়া এলাকার আনন্দ কুমার পালের দুই ছেলে পলাশ কুমার পাল ও মিলন কুমার পালের নাম দেখা যায়।
বুধবার (৯ অক্টোবর) বিকেলে পলাশ কুমারের মুঠোফোনে বাংলালিংকের একটি নম্বর থেকে অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি ফোন করে তাদের দুই ভাইয়ের নামে মামলা হচ্ছে বলে জানান। পরে পলাশ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে ফিরতি কল করে সহযোগিতা চাইলে তিনি টাকা চান এবং রাত ১১টার মধ্যে তার সঙ্গে দেখা করতে বলেন।
পলাশ ও ওই ব্যক্তির ২০ মিনিটের কথোপকথনের একটি অডিও গণমাধ্যমের হাতে এসেছে। পলাশ পরে প্রথম আলোকে কথোপকথনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। কথোপকথনে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি বাদী তার পূর্বপরিচিত উল্লেখ করে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পরিস্থিতি উল্লেখ করেন।
তবে পুলিশ বলছে, মাহামুদুল হাসান নামের কেউ থানায় কোনো এজাহার দেননি। ভুয়া এজাহারের কথা বলে চাঁদাবাজির বিষয়টি নিয়ে পুলিশ কাজ করছে। অন্যদিকে বিএনপির নেতারা বলছেন, কিছু ব্যক্তি নিরীহ মানুষকে ফোন করে আসামি করে টাকা চাচ্ছেন, বিষয়টি তারাও শুনেছেন। এ ব্যাপারে তাঁরা পুলিশকে জানিয়েছেন।
২০ মিনিটের কথোপকথনে পলাশ কুমার ফোন করে ওই ব্যক্তির কাছে সাহায্য চাইলে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি বলেন, “এখন অপশন আছে, মনে করেন ১১টার আগ পর্যন্ত যে কারও পাঠান। মনে করেন মামলা এন্ট্রি হবে, রাত ১১টার আগে আসতে হবে।’
তিনি পলাশ বা তার ভাইকে ভেড়ামারায় গিয়ে দেখা করতে বলেন। কত টাকা লাগবে জানতে চাইলে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি বলেন, ‘টাকাপয়সা, মেলাজন তো মেলা রকমভাবে করছে। একটু আগেও একজন আইছিল। আমার নম্বর দিয়েই ফোন দেওয়া হয়েছিল। পরে আমিই বাদীর কাছে পাঠা দিলাম। পরে ওই লোক আইসি আমাকে ধরেছে, ভাই আপনি আইসেন।”
পলাশ তখন কীভাবে কী করতে হবে জানতে চাইলে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি বলেন, ‘কেডা কী দিচ্ছে আমি জানি না। একজন দিছে ৩০ হাজার টাকা, আরেকজনের নামটাম বেশি, সে দিছে ৫০ হাজার টাকা। এ রকম আরেকজন দিছে খালি ২০ হাজার টাকা বুঝলেন। মানে ওরা রানিং, যেগুলো পাচ্ছে নিয়ে নিয়ে (টাকা) নাম কাটা দিচ্ছে। আবার অনেকেই বলছে এর বেশি দিতে পারব না, টাকা নেই, প্রয়োজনে মামলা দিয়ে ধরা দেন, এমনও বলছে...এইভাবে কথা বললে হবে আমার ধারণা। কারণ, যে বাদী তার হয়ে কাজ করি। মেলা দিন ধরে তার কাজ করি, এই জন্য আমার নম্বর দিয়ে ফোন দেওয়াইছে। তারা সরাসরি ফেস হচ্ছে না।’ বাদীর বাড়ি কোথায় জানতে চাইলে তিনি পলাশের বাড়ির আশপাশে, কুষ্টিয়ারই বলে জানান।
কথোপকথনের বিষয়ে পলাশ কুমার প্রথম আলোকে বলেন, ‘৯ অক্টোবর বিকেলে এক ব্যক্তি ফোন করে মামলায় আসামি হওয়ার কথা জানান। তখন তিনি একটু ঘাবড়ে যান। কথা প্রসঙ্গে ফোনের অপর প্রান্তের ব্যক্তি বিষয়টি মিটিয়ে দেবেন বলে জানান। কথোপকথনের একপর্যায়ে তাঁর আচরণে সন্দেহ হয়। পরে পুরো ঘটনা পুলিশকে জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে অজ্ঞাতপরিচয়ে ফোন করা ওই নম্বরে কল করলে না ধরে কেটে দেওয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা ও প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, নম্বরটি শাবাবুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির। বাবার নাম আবদুস সামাদ। বাড়ি কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার বামনপাড়া গ্রামে। পরে তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি কোনো টাকা চাননি বলে দাবি করেন। ওই ব্যক্তি সাদ্দাম নামের এক ব্যক্তির মুঠোফোন নম্বর দিয়ে বলেন, “সেই সব জানে।”
এ বিষয়ে সাদ্দাম নামের ওই ব্যক্তির মুঠোফোন নম্বরে কল করলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। অন্যদিকে এজাহারে উল্লিখিত বাদী মাহামুদুল হাসান রোমানের ঠিকানা সূত্র ধরে খোঁজ করা হয়। সেখানে মাহামুদুল হাসান নামের কাউকে পাওয়া যায়নি। এ জন্য তাঁর সঙ্গে কথা বলাও সম্ভব হয়নি।
এদিকে শুক্রবার (১১ অক্টোবর) রাতে কুষ্টিয়ার ধনাঢ্য দুই শিল্পপতির কাছে ওই এজাহারের একটি কপি পাঠানো হয়। একই বাদীর নামে প্রস্তুত করা ওই এজাহারে আসামির তালিকায় তাদের দুই ভাইয়ের নাম দেওয়া হয়েছে। তারাও আতঙ্কে আছেন বলে জানিয়েছেন।
তবে কুষ্টিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহাফুজুল হক চৌধুরী বলেন, “মাহামুদুল হাসান রোমান নামের কেউ বাদী হয়ে থানায় অভিযোগ দেয়নি। ওই মামলা নিয়ে আমার কিছুই জানা নেই।”
এ বিষয়ে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কুতুব উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, “কিছু ব্যক্তি মামলায় আসামি করার নামে ব্যাপক চাঁদাবাজি করছে। নিরীহ লোকজনকে আসামি করার নামে তাঁদের ফোন দিয়ে টাকা দাবি করছে। এভাবে লাখ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে, যা দুঃখজনক। আমরা থানার ওসি ও পুলিশ সুপারকে বিষয়টি দেখার জন্য বলেছি।”
জানতে চাইলে কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম, অপারেশন ও মিডিয়া) পলাশ কান্তি নাথ জানান, “এ রকম একটি ঘটনার কথা শুনেছেন। বিষয়টি নিয়ে পুলিশ কাজ করছে।”