‘আমার পাঁচ আত্মা আমার বাবার কাছে থাকত। কইছি তুমি দেখে শুনে অপারেশন কইরো। তুমি দেশের জন্য কইরো, দশের জন্য কইরো, তোমার জন্য কইরো। দেশের জন্য সব করছে আমার বাজান। আমার সহজ সরল, আত্মত্যাগী বাবা ছিল। আমার জীবনত্যাগী বাবা জীবন দিয়ে গেল। আমি প্রধান উপদেষ্টার ও সেনাপ্রধানের কাছে বিচার চাই দুর্বৃত্তদের আইনের আওতায় আনুন।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন কক্সবাজারের চকরিয়ায় অভিযানের সময় ডাকাতের ছুরিকাঘাতে নিহত সেনা সদস্য লেফটেন্যান্ট তানজিম সারোয়ারের মা নাজমা বেগম।
সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) রাত সাড়ে ৩টায় ডুলহাজারা ইউনিয়নের মাইজপাড়া এলাকায় সন্ত্রসীদের ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হন এই সেনা কর্মকর্তা। পরে তাকে কক্সবাজারে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) ভোরে রামু এলাকায় পৌঁছলে মারা যান তিনি।
নিহত সেনা সদস্য লেফটেন্যান্ট তানজিম সারোয়ার টাঙ্গাইল পৌর শহরের করের বেতকা এলাকার ছারওয়ার জাহান দেলোয়ারের ছেলে।
তানজিম সারোয়ার পাবনা ক্যাডেট কলেজ হতে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ৮২তম দীর্ঘমেয়াদি কোর্সে ২০২২ সালে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি থেকে আর্মি সার্ভিস কোরে (এএসসি) কমিশন লাভ করেন। তিনি টাঙ্গাইল বিন্দুবাসিনী সরকারি বালক বিদ্যালয় থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পাস করে পাবনা ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হন। ২০১৭ সালে এসএসসি এবং ২০১৯ সালে এইচ এস সি পাস করেন। পঞ্চম শ্রেণিতে তিনি ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলেন।
তানজিমের বাবা দীর্ঘদিন আর্জেটিনা প্রবাসী ছিলেন। গত আড়াই বছর ধরে তিনি বাড়ি এসেছেন। ছেলে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হওয়ার পর আর বিদেশে যাবেন না বলে মনস্থির করেছিলেন। তানজিমের এক বোন রয়েছে। তার নাম তাসনুভা ছারওয়ার।
তানজিমের বাবা ছারওয়ার জাহান দেলোয়ার বলেন, ছেলেকে ঘিরে অনেক প্রত্যাশা ও স্বপ্ন ছিল। সব যেন এক নিমিষেই ধুলিসাৎ হয়ে গেল। দুইদিন আগেও ছেলের সঙ্গে কথা হয়েছে। তুমি ভালো থেকো এবং মাকে দেখে রেখো। ছেলে আমার খুবই মেধাবী ছিল। সব কিছুতেই প্রথম হতো। খেলাধুলা থেকে শুরু করে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় সে খুবই পারদর্শী ছিল। তার রুমের ভেতরে শুধু পুরস্কার দিয়ে ভরা। ছেলে বলত সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশ সেবায় আত্মনিয়োগ করবে। আজ দেশের জন্য সে জীবন দিল। আমি সরকারের কাছে দাবি করছি যারা আমার ছেলেকে হত্যা করেছে তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে কঠিন শাস্তি দিতে হবে।”
মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে করের বেতকার বাসায় গিয়ে দেখা যায়, নির্জনের নিহতের খবর শুনে পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয়-স্বজন বাসায় এসে ভীর করছেন। মা ও একমাত্র বোন কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। নির্জনের একমাত্র ভাগ্নি সানিকা হক সারা মামার মৃত্যু কথা শোনার পর থেকে শুধু কেঁদেই চলেছে। তাদের কান্না দেখে অনেকেই চোখের পানি ফেলছেন। ছেলের মৃত্যুর পর থেকে বাবাও বাকরুদ্ধ। অমিত সম্ভাবনাময় এমন একটি তরতাজা জীবন এভাবে ঝড়ে যাবে কেউই ঘটনাটি মেনে নিতে পারছেন না।
মামাতো ভাই মীর পলাশ বলেন, “তানজিমের ইচ্ছাই ছিল আর্মি অফিসার হয়ে সে দেশের সেবা করবে। এলাকার অত্যন্ত মেধাবী মুখ সে। এছাড়া ছোট বেলা থেকেই সে খুবই সাহসী। খেলাধুলায় যেমন পারদর্শী ছিল, তেমনি ছিল উপস্থিত বুদ্ধি। বাস্কেট বল খেলতে খুব পছন্দ করত। সন্ত্রাসী ডাকাতদের জন্য দেশের এমন মেধাবী অফিসারের মৃত্যু হবে এমনটা মেনে নেওয়া যায় না।”
নির্জনের ভগ্নিপতী এনামুল হক সম্রাট বলেন, “সোমবার রাত ১১টার দিকে ফোন করে বোনকে বলেছে ‘আপু আমি দল নিয়ে বড় একটি অপারেশনে যাচ্ছি। দোয়া কইরো।’ এটাই তার সঙ্গে শেষ কথা। সকালে ফোন পাই যে ডাকাতের ছুরিকাঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে। তাকে আমি কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি। আমি এ কষ্ট সইব কী করে।”
এদিকে চট্টগ্রাম থেকে সামরিক একটি হেলিকপ্টারে তানজিমের মরদেহ বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে টাঙ্গাইল হেলিপ্যাডে অবতরণ করে। পরে সেখান থেকে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় করের বেতকা বাসায়। মরদেহ পৌঁছলে স্বজনদের মাঝে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। বাদ আছর বোয়ালী জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে জানাজা শেষে বোয়ালী সামজিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
এসময় টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক শরীফা হক, পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতুসহ সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।