ঢাকার কেরাণীগঞ্জে রূপালী ব্যাংকের জিঞ্জিরা শাখায় ডাকাতির ঘটনার অন্তরালে পাওয়া গেছে অবিশ্বাস্য তথ্য। তিন কিশোর মুভি দেখে অ্যাডভেঞ্চার হিসেবে খেলনা পিস্তল নিয়ে সেখানে গিয়েছিল ডাকাতি করতে।
আত্মসমর্পণের পর কিশোররা পুলিশকে জানায়, মৃত্যুশয্যায় থাকা একজন কিডনি রোগীকে বাঁচাতে তাদের দরকার ছিল ১২ লাখ টাকা। আর তাদের আইফোন কেনারও প্রয়োজন ছিল। সেজন্য তারা খেলনা পিস্তল দেখিয়ে ব্যাংকের ম্যানেজারকে জিম্মি করে ১৫ লাখ টাকা দাবি করেছিল।
বৃহস্পতিবার (১৯ ডিসেম্বর) রাতেই কেরাণীগঞ্জ মডেল থানায় আয়োজিত ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানিয়েছেন ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) আহম্মদ মুঈদ।
ঘটনার সময় রূপালী ব্যাংকের জিঞ্জিরা শাখার ম্যানেজার, গ্রাহক ও কর্মী মিলে মোট ১৪ জন ভেতরে জিম্মি হয়ে পড়েছিলেন। পরে গ্রাহকরা জানিয়েছেন তাদের সাড়ে তিন ঘণ্টা জিম্মি অভিজ্ঞতার কথা। এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে প্রথম আলো।
প্রতিবেদনে জিম্মি হওয়া ব্যাংকের গ্রাহক বাবুল খানের অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়েছে। যিনি পেশায় ঠিকাদার। বাড়ি চুনকুটিয়া এলাকায়। বাবুল খান বলেন, “আমরা আতঙ্কগ্রস্ত ছিলাম। মনে হয়েছিল, গোলাগুলি হতে পারে। কেউ প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারব না। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি সব শেষ! তবে পরে শুনছি অস্ত্রগুলো ছিল নকল। আগে জানলে এত আতঙ্কগ্রস্ত হতাম না।”
সেই মুহূর্তের ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরে বাবুল খান বলেন, “ব্যবসার টাকা জমা দিতে বেলা দুইটার দিকে ব্যাংকে যাই। ক্যাশ কাউন্টারে এক কর্মকর্তার কাছে টাকা জমা দিই। যখন টাকা গুনছিলাম, তখন মাস্ক ও চশমা পরা তিনজন ব্যাংকে ঢোকেন। তারা সঙ্গে করে একটি তালা নিয়ে এসেছিলেন।”
বাবুল খান বলেন, “ঢোকার পরপরই তারা ওই তালা দিয়ে ব্যাংকে ঢোকার দরজা বন্ধ করে দেন। এরপর দুজন নিরাপত্তাপ্রহরীকে পিস্তলের ভয় দেখিয়ে মেঝেতে বসিয়ে রাখেন। ব্যাংকে তখন কর্মকর্তা-কর্মচারী, গ্রাহকসহ প্রায় ১৭ জন ছিলেন। তারা সবাইকে পিস্তলের ভয় দেখিয়ে এক জায়গায় নিয়ে মাথা নিচের দিকে উপুড় করে বসতে বলেন।”
কিশোরদের কর্মকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে বাবুল খান জানান, তারা সবার মোবাইল কেড়ে নেয়। কারও মোবাইলে কল এলেই তারা ছোঁ মেরে রিসিভ করছিল। তারা সিসিটিভি ক্যামেরা ভাঙচুর করে তার ছিঁড়ে ফেলে। কিছু আসবাব ভাঙচুর করে। এতে সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে পিস্তল তাক করে দুজন সবাইকে পাহারা দেন। বাকি একজন ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ব্যাগে ভরছিল।”
তবে এক পর্যায়ে কিশোরা টের পান ব্যাংকের বাইরে অনেক মানুষ জড়ো হয়েছেন। ব্যাংক থেকে তাদের বের হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এসময় তারা ব্যাংকের পেছনের দিকে থাকা লোহার গ্রিল ভেঙে বের হওয়ার চেষ্টা করে। তবে গ্রিল ভাঙতে ব্যর্থ হয়।
পরে তারা ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চান মূল দরজার বাইরে বের হওয়ার অন্য কোনো পথ আছে কি না। ব্যাংকের কর্মকর্তারা বের হওয়ার পথ শুধু একটি বলে জানান। এরপরও তারা বের হওয়ার অনেক চেষ্টা করেন, কিন্তু ব্যর্থ হন।
তবে গ্রাহকরা জানান ব্যাংকে হানা দেওয়া তিনজন কাউকে মারধর করার চেষ্টা করেনি। তারা ক্ষিপ্তও ছিল না। তারা গ্রাহকদের বলেছে,“এই টাকা সরকারের। তবে আপনারা চালাকি করলে জীবন যাবে।” সেই কথা শুনে গ্রাহকরা ভয় পেয়ে যায়।
বাবুল খান জানান, ঘটনার সময় সময় ব্যাংকের এক নারী কর্মচারী কান্নাকাটি করছিলেন। কিশোররা কান্নারত নারীকে ব্যাগ থেকে এক লাখ টাকা দিয়ে বলেন, “আপনি বেশি আতঙ্কিত হয়েছেন। এই টাকা আপনি রাখেন, এটা আপনার জন্য।”
এভাবেই ব্যাংকের আতঙ্কিত সময়গুলো কেটে যাচ্ছিল। এক পর্যায়ে তিন কিশোর পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে নাশতা, কোমল পানীয়, সিগারেট ও পানি আনান। কোমল পানীয় তারা গ্লাসে ঢেলে সবাইকে পান করতে দিয়েছিলেন। নাশতাও খেতে দিয়েছিলেন। তারা যে টাকা নিয়েছিলেন, সেই টাকা থেকে এক লাখ টাকা ব্যাংকের ক্যামেরা ও আসবাব ভাঙচুরের ক্ষতিপূরণ বাবদ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দেন।
বিকেলে ব্যাংকের বাইরে সেনাবাহিনীর আসার খবর পেয়ে তিন কিশোর আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এর আগে সবাই চাঙা ছিলেন। এসময় কর্মকর্তা, কর্মচারী ও গ্রাহকদের অনেকেই মেঝেতে বসা পড়া থেকে উঠে চেয়ারে ও সোফায় বসেন। সবার মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসে।
সে সময় কিশোর তিনজন সিগারেটের ছাই রাখার অ্যাশট্রের মধ্যে মোবাইল ঢুকিয়ে কিছু ছেঁড়া তার যুক্ত করে স্কচটেপ পেঁচিয়ে বোমাসদৃশ বস্তু বানান। তারা যখন বের হচ্ছিল, তখন ব্যাংকের কর্মকর্তাকে বলে, আমরা বের হওয়ার পর যদি কোনো চালাকি করেন, তাহলে আমাদের মুঠোফোন থেকে একটি কল দেওয়ার পরপরই এ বোমার বিস্ফোরণ ঘটবে। তখন আর কেউ বেঁচে ফিরতে পারবেন না।
কিশোরদের এমন হুমকির কথা শুনে ব্যাংকের ভেতরে থাকা সবাই ভয় পেয়ে যান। পরে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় তারা অক্ষত অবস্থায় ব্যাংক থেকে বের হন।