জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলার দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত সিরাজগঞ্জ জেলার সীমানা ঘেঁষা যমুনা নদী দ্বারা বেষ্টিত চরাঞ্চলের একটি গ্রামের নাম চর নলসন্ধ্যা। এ চরাঞ্চলবাসীর জীবনমান সমতল ভূমিতে বসবাসরত সাধারণ মানুষের মতো নয়। তারা প্রতিনিয়ত যমুনা নদীর সঙ্গে সংগ্রাম করেই জীবনযুদ্ধে টিকে আছেন।
এ অঞ্চলের অনেকের একসময় শ শ একর জমি ছিল, ছিল গোয়াল ভরা গরু, গোলাভরা ধান। কিন্তু যমুনা নদী তার ভাঙা-গড়ার খেলায় তাদের নিঃস্ব করেছে। অনেকে হয়েছেন পথের ফকির। কেউ হয়েছেন দেশান্তরি। আবার কেউ কেউ একাধিকবার বাড়ি সরিয়ে চরেই নিজের ঠিকানা খোঁজে ফিরছেন।
নলসন্ধ্যা গ্রামটি মূলত পিংনা ইউনিয়নের চরাঞ্চলে অবস্থিত। যমুনা নদীর একটি শাখা উত্তরের কাজিপুরের মনছুর নগর ইউনিয়নের পেছন দিয়ে প্রবাহিত সরিষাবাড়ির শেষপ্রান্ত নলসন্ধ্যার, ডাকাতিয়ামেন্দ হয়ে টাঙ্গাইলের নলীন হয়ে যমুনা সেতুর কাছে গিয়ে ফের যমুনার মূল স্রোতের বুকে পড়েছে। তবে পূর্বে ওই গ্রামটি যমুনার ভাঙনের কবলে পড়লে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।
নলসন্ধ্যা এ গ্রামের সিংহভাগ মানুষই নিম্নবিত্ত শ্রেণির। তাদের অধিকাংশই শ্রমজীবী। দিনমজুরি করেই তাদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। এখানে নারী-পুরুষ উভয়েই মিলেমিশে ক্ষেতে-খামারে এবং গৃহস্থলীর কাজ করেন।
গ্রামের রাস্তা-ঘাটগুলো কাঁচা এবং খানাখন্দকে ভরা। এখানকার বাড়িগুলো প্রকার ভেদে কখনো পুরো গ্রামজুড়েই এক সমান তালে সারিবদ্ধ। আবার কখনো একটা থেকে অন্যটা বেশ দূরে। এ গ্রামেই বাস করেন পরিশ্রমী নারী লাভলী বেগম। দুর্গম নিভৃত পল্লী প্রকৃতির নির্জনতায় ছোট্ট একটা শান্তির নীড় যেন লাভলী বেগমের বসতভিটা। বিচিত্র গাছপালা আর পাখির কুজনে মুখর বাড়ির আঙিনা।
শ্যামলা বর্ণের মাঝারি গড়নের লাভলী বেগম কোনো প্রকার জড়তা বা ইতস্ততা প্রদর্শন না করে প্রশ্ন করে সহজ-সরল ভাষায় তিনি জানান, বাবা-মার সিদ্ধান্তে অপ্রাপ্ত বয়সে ১৫ বছর আগে বিয়ে হয়েছে। সুখী দাম্পত্য জীবনে তাদের দুটি ছেলে। একজন ক্লাস নাইনে, অন্যজন ক্লাস সিক্সে পড়ে। স্বামী সুলতান মিয়া একজন রাজমিস্ত্রি। বর্তমানে তিনি কুমিল্লা জেলায় কাজ করছেন।
তিনি অকপটে জানান, স্বামীর সামান্য আয়ে সংসার চলে না, তাই ঘর সামলানোর পাশাপাশি সেও ক্ষেতে-খামারে কাজ করে। স্বামীর পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া ২ বিঘা জমিতে ভুট্টার আবাদ করেছেন। ওই ক্ষেতে নিরানি থেকে শুরু করে যাবতীয় পরিচর্যা তিনি নিজেই করেন। গেল বছর একই জমিতে ভুট্টার আবাদ করে ১০০ মণ ফলন হয়েছিল, যা ১২শ টাকা মণ দরে ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। বর্তমানে প্রতি মণ ভুট্টা ১৮-১৯শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এবার প্রায় ২ লাখ টাকার ভুট্টা বিক্রি করতে পারবেন বলে জানান।
লাভলী বেগম বলেন, “গত বৈশাখে ৩৫ হাজার টাকায় একটি দেশি ষাঁড় বাছুর কিনে চারমাসের মাথায় তা ৫৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। এ সময় ষাঁড়ের পেছনে খাদ্য ক্রয়ের খরচ বাদে ১৩ হাজার টাকা লাভ হয়েছে।”
লাভলী বেগম জানান, গরু বিক্রি এবং গতবারের ভুট্টা বিক্রির অর্থে গত দুই মাস আগে ৭৫ হাজার টাকায় এক বছর বয়সি বেলজিয়াম জাতের একটি বকনা বাছুর কিনেছেন। ১৬ থেকে ১৮ মাস বয়সে বাছুরের পেটে বাচ্চা আসার কথা। বাচ্চা প্রসবের পর এই গাভী থেকে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ লিটার দুধ পাওয়ার আশা করছেন তিনি। এছাড়া গত ৫০ দিন আগে তিনি ২০ টাকা দরে ৪০টি দেশি মুরগির বাচ্চা কিনে বাড়িতে একটি মুরগির খামার করেছেন। সেখান থেকে ইতোমধ্যেই তিনি ২০০ টাকা করে আটটি মুরগি ১৬শ’ টাকায় বিক্রি করেছেন। এসব কাজে তার দুই ছেলেও তাকে সহযোগিতা করছেন।
এভাবেই জীবনের লড়াইয়ে জয়ের পতাকা হাতে এগিয়ে চলেছেন লাভলী।
আবেগ তাড়িত হয়ে লাভলী বেগম বলেন, “দুই বছর আগেও তার সংসারে অভাব অনটন ছিল। স্বামী উদয়াস্ত পরিশ্রম করার পরও বাচ্চাদের মুখে পুষ্টিকর খাবার তুলে দেওয়া দূরে থাক দুইবেলা আহার যোগানোই কষ্টকর ছিল। মাংস, দুধ, ডিমের মতো পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার ছিল ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু স্বামীর পাশাপাশি আমি যখন সংসারের উন্নতির জন্য নিজে ক্ষেতে-খামারে কাজ শুরু করলাম, তখন থেকে ভাগ্য বদলাতে শুরু করেছে। এখন বাচ্চারা পুষ্টিকর খাবার খেতে পারছে। ভালো পোশাক পড়তে পারছে। সংসারে আস্তে আস্তে সুখ-স্বাচ্ছন্দ উঁকি দিচ্ছে।”
নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন, সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখার দুঃসাহস, যমুনা নদীর সঙ্গে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার প্রেরণা, নিজেদের অধিকার আদায়ে সচেতন, সর্বোপরি সংসারে সুখ আনতে স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই সমান অবদান রাখার পথ যারা লাভলী বেগমকে দেখিয়েছেন এবং শ্রমজীবী নারী হতে যারা তাকে সহযোগিতা করেছেন তারা ‘মেকিং মার্কেটস ওয়ার্ক ফর দি চরস (এমফোরসি)’ এ কর্মরত সদস্যরা। তাদের পরামর্শ এবং সহযোগিতার কথা তিনি কৃতজ্ঞতাচিত্তে স্মরণ করেন।
এ বিষয়ে লাভলী বেগম বলেন, “২০২০ সালে এমফোরসি এই চরে তাদের কার্যক্রম শুরু করেন। মাত্র দুই থেকে আড়াই বছরে আমার মতো অনেকেই তাদের সান্নিধ্যে এসে নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।”
এই গ্রামের অধিবাসীদের জীবন যাত্রার মান আর দশটি গ্রামের মতো নয়। প্রতিনিয়ত যমুনা নদীর সঙ্গে যুদ্ধ করে তারাও সংগ্রামী হয়ে উঠেছেন। তাদের মননে, চিন্তনে, অনুচিন্তনের যে চেতনা সেটা কেবল তাদের ঘিরেই আবর্তিত। তারা আজ নিছক ভাগ্যের ওপর ভরসা করে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে চান না।
ওই গ্রামের কামাল হোসেন বলেন, “নারী-পুরুষ নির্বিশেষে চরাঞ্চলবাসী তাদের প্রতিটি হাতকে কর্মীর হাতে রূপান্তর করে নিজেদের অবস্থার পবির্তন করার পাশাপাশি সমাজ সংস্কারেও তারা অবদান রাখছেন। চর নলসন্ধ্যা গ্রামের মানুষের দারিদ্রের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ যাত্রার অবসান হোক, স্বপ্ন পূরণ হোক লাভলীর।”