টাঙ্গাইল জেলায় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আতিয়া জামে মসজিদ। দশ টাকার মসজিদ নামে পরিচিত আতিয়া জামে মসজিদটি জেলার দেলদুয়ার উপজেলায় অবস্থিত। টাঙ্গাইল সদর থেকে ৬ কিলোমিটার দক্ষিণে দেলদুয়ার উপজেলার আতিয়া গ্রামে মসজিদটির অবস্থান।
দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মুসুল্লি ও পর্যটক আসেন এখানে। নামাজ পড়ার পাশাপাশি তারা ঘুরে দেখেন প্রাচীন ও ঐত্যিহাসিক এ মসজিদটি। তবে দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় মসজিদটি হারাচ্ছে তার সৌন্দর্য। নষ্ট হচ্ছে কারুকাজগুলোও। মসজিদে আসার সড়কটিও ভাঙাচুড়া। দ্রুত এই মসজিদ ও সড়ক সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী, মুসুল্লি ও পর্যটকেরা।
মসজিদের নামকরণের ইতিহাস :
আতিয়া মসজিদটির নামকরণে রয়েছে একটি ইতিহাস। আরবি শব্দটা ‘আতা’ থেকে ‘আতিয়া’। যার অর্থ হচ্ছে ‘দানকৃত’। আলি শাহান শাহ্ বাবা আদম কাশ্মীরিকে (র.) সুলতান আলাউদ্দিন হুসাইন শাহ টাঙ্গাইল জেলার জায়গির হিসেবে নিযুক্ত করেন। পরে আদম কাশ্মীরি (র.) এ অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন। আফগান নিবাসী কররানী শাসক সোলাইমান কররানীর কাছ থেকে ওই এলাকাটি দান হিসেবে পান। এলাকাটি দান সূত্রে পাওয়ায় অঞ্চলের নাম হয়েছে আতিয়া আর এলাকার নামানুসারে মসজিদটির নাম হয়েছে আতিয়া জামে মসজিদ।
মসজিদ নির্মাণ ইতিহাস :
শাহ্ বাবা আদম কাশ্মীরি (র.) বৃদ্ধ বয়সে তার প্রিয় ও বিশ্বস্ত ভক্ত সাঈদ খান পন্নীকে মোগল বাদশাহ জাহাঙ্গীর আতিয়া এলাকার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। সাঈদ খান পন্নী ১৬০৮ সালে মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদটির স্থপতি মুহাম্মদ খাঁ।
মসজিদটির বৈশিষ্ট্য :
মসজিদটিতে সুলতানি ও মোগল আমল উভয় আমলের বৈশিষ্ট্যের সুস্পষ্ট নিদর্শন রয়েছে। সুলতানি আমলের নিদর্শন হচ্ছে মিহরাব, কিবলা দক্ষিণ এশীয়দের জন্য পশ্চিমে। আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মসজিদের খিলানসমূহ।
আতিয়া মসজিদের খিলানগুলো চতুর্কেন্দ্রিক। চতুর্কেন্দ্রিক মানে হলো মসজিদটিতে চারটি দিক (উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম) দিয়ে প্রার্থনা কক্ষে প্রবেশ করা যায়। কিবলা দেয়ালে তিনটি অলঙ্কিত মিহরাব আছে। আর মসজিদটি টেরাকোটার ইটের তৈরি। চুন, সুরকি গাঁথুনি দিয়ে মসজিদটি নির্মিত। আর সুলতানি আমলে প্লাস্টার পদ্ধতি ছিল না। তারা চুন ও সুরকির গাঁথুনি দিয়ে মসজিদ নির্মাণ করত। বক্রাকার কার্নিশ, সুচালো খিলান ও গম্বুজ সবই সুলতানি আমলের নিদর্শন।
আতিয়া মসজিদের পূর্ব ও উত্তর দিকের বাইরের দেয়ালে টেরাকোটার ওপর চমৎকার বৃত্তের মাঝে ফুলের নকশা করা, যা মোগল আমলের নিদর্শন।
বিবরণ :
মসজিদটির আকার দৈর্ঘ্য ১৮ দশমিক ২৯ মিটার, প্রস্থ ১২ দশমিক ১৯ মিটার, দেয়ালের পুরুত্ব ২ দশমিক ২৩ মিটার। মসজিদের চার কোনা অষ্টকোনাকৃতি মিনার রয়েছে। মসজিদটি টেরাকোটার তৈরি। বাংলাদেশের অধিকাংশ মসজিদগুলো ইটের তৈরি। কারণ আমাদের এই দেশে পাথর সহজলভ্য না।
পাথর দিয়ে তৈরি করতে চাইলে অন্য দেশ থেকে পাথর আমদানি করে আনতে হবে। এই প্রক্রিয়াটি যথেষ্ট ব্যয়বহুল, সময় সাপেক্ষ। আদিতে মসজিদের ছোট তিন গম্বুজগুলো পলকাটা বা ঢেউ তোলা ছিল। প্রধান গম্বুজটি ধসে পড়েছিল সে জন্য পলকাটা বা ঢেউ তোলা বৈশিষ্ট্যটি বর্তমানে বিলুপ্ত।
মসজিদ থেকে প্রাপ্ত নিদর্শন :
মসজিদটি থেকে একটি আরবি ও একটি ফারসি শিলালিপি পাওয়া যায়। এই লিপিগুলো থেকে মসজিদের নির্মাতার সময়কাল জানা যায়।
সংস্করণ :
রওশন খাতুন চৌধুরানী ১৮৩৭ সালে ও আবুল আহমেদ খান গজনবি ১৯০৯ সালে মসজিদটি সংস্করণ করেন। বাংলাদেশ সরকার মসজিদটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে অধিগ্রহণ করে। বর্তমানে চুনকামের অভাব, অবহেলা, অযত্নে হারাতে বসেছে ৪০০ বছরের পুরোনো ঐতিহ্য।
টাকায় আতিয়া মসজিদ :
বাংলাদেশের পুরোনো দশ টাকার নোটে রয়েছে আতিয়া জামে মসজিদটির ছবি। যার জন্য মোটামুটি সবার কাছে পরিচিতি আতিয়া জামে মসজিদটি। আতিয়া মসজিদের নাম একবার হলেও শোনেনি এমন ব্যক্তি হয়তো খুঁজে পাওয়া দুর্লভ। মসজিদটি দশ টাকার মসজিদ নামেও পরিচিত অনেকের কাছে। সবার দাবি দশ টাকার নোটে আবারও ফিড়িয়ে আনা হোক আতিয়া মসজিদের ছবি।
যেভাবে আসবেন :
দেশের যে কোনো স্থান থেকে বাস অথবা ট্রেনে টাঙ্গাইল শহরে এসে সিএনজি চালিত অটো বা অন্য কোনো যানবাহনে আসতে হবে আতিয়া মসজিদে। ব্যক্তিগত যানবাহন নিয়ে টাঙ্গাইল জেলা শহর অথবা দেলদুয়ার উপজেলা সদর হয়ে সরাসরি যাওয়া যাবে আতিয়া মসজিদে।