‘গাছ লাগাই পরিবেশ বাঁচাই’ এই স্লোগানটিকে মনে প্রাণে ধারণ করে প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা থেকেই দীর্ঘ ৮ বছর ধরে নিজের শ্রম, মেধা আর অর্থ ব্যয় করে বৃক্ষরোপণ করে চলেছেন কুড়িগ্রামের আনোয়ার হোসেন।
দীর্ঘ আট বছরে জেলা শহরের বিভিন্ন গ্রামীণ ও শহরের সড়ক, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, নদীর বাঁধ, কবরস্থানগুলোতে ৭ হাজারের বেশি গাছ লাগিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া শহরের অপরিচ্ছন্ন ও অস্বাস্থ্যকর জায়গাগুলোতে ফুলের গাছ লাগিয়ে দিয়েছেন সুন্দর পরিবেশ।
গাছ রোপণ করেই তিনি থেমে থাকেননি। প্রতি শুক্রবার রোপণকৃত এসব গাছের পরিচর্যা করেন নিজ হাতেই। বেড়া দেওয়া থেকে শুরু করে গাছের ডাল ছাঁটাই, পানি ও সার দেওয়াসহ সবকিছুই করেন তিনি। তার রোপণ করা অধিকাংশ গাছে এখন শোভা পাচ্ছে ফল ও ফুল।
শহরের ধরলা সেতু পাড়, স্টেডিয়াম, পৌর বাজার, চর হরিকেশ, হলোখানা, বাসস্ট্যান্ড, সার্কিট হাউস, কাঁঠালবাড়ি বাংটুর ঘাট, টাপুরচরসহ বিভিন্ন স্থানে আনোয়ারের রোপণ করা কৃষ্ণচূড়া, বকুল, কাঠবাদাম, বট, সোনালু, জলপাই, কামরাঙা, জামরুল, লেবুসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ সবার চোখে পড়ে।
এ ছাড়া পৌর কর্তৃপক্ষ ও সড়ক বিভাগের অনুমতি নিয়ে শহরের রোড ডিভাইডারগুলোতে গড়ে তুলেছেন ফুলের বাগান।
আনোয়ারের এসব কাজে সহযোগিতা করছেন একঝাঁক তরুণ শিক্ষার্থী। তাদের অধিকাংশই ওরাকল লাইব্রেরির পাঠক। শিক্ষার্থীদের মাঝে উৎসাহ ও উদ্দীপনা বাড়াতে এই লাইব্রেরিটি গড়ে তুলেছেন তিনি। তবে অধিকাংশ সময় তিনি একাই এসব কাজ করেন। বর্তমানে তার বসতভিটায় বিভিন্ন প্রজাতির আরও ৪-৫ হাজার চারাগাছ রয়েছে। যেগুলো রোপণের জন্য পরিচর্যা করা হচ্ছে।
বৃক্ষপ্রেমী এই আনোয়ার হোসেন কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের টাপুরচর গ্রামের মৃত আয়নুল হকের ছেলে। তিনি পেশায় টাপুরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরি পদে কর্মরত।
আনোয়ারের প্রতিবেশী আবুল কাশেম বলেন, “আনোয়ার গাছ পাগল একটা মানুষ। দপ্তরী পদে থেকেও কাজের ফাঁকে পরিবেশকে সুন্দর রাখতে তার এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। আমি আমার জমি থেকে নিয়মিত গাছের বেড়া ও খুঁটির জন্য বাঁশ দেই। তার কাজে সহযোগীতা করতে পারলে আমারও ভালো লাগে।”
কলেজছাত্র নাজমুল হোসেন বলেন, “ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। আনোয়ার চাচার গাছের প্রতি একটি আলাদা ভালোবাসা। প্রকৃতি ও পরিবেশ আমাদের নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসে। বিনিময়ে আমরা বৃক্ষ নিধন করে বন উজার করছি। যার ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের প্রত্যেকের উচিত তাকে সহযোগিতা করা।”
আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী ফাতেমা বেগম বলেন, “বিয়ে হবার ৬ বছর হলো। সেই সময় থেকে দেখছি সংসারে তার মন না থাকলেও গাছের প্রতি তার আলাদা টান রয়েছে। আমাদের কোনো সন্তান নেই। একটু অবসর পেলেই গাছকে সে সন্তানের মতো ভালোবাসে। অনেক বছর ধরে এ কাজে অনেক শ্রম দিচ্ছে। সরকারিভাবে যদি তাকে কোনো সহযোগিতা করা হত, আমার বিশ্বাস সে আরও অনেক দূর এগিয়ে যেত।”
এ ব্যাপারে বৃক্ষপ্রেমী আনোয়ার হোসেন বলেন, “গাছের প্রতি অগাধ ভালোবাসার মধ্য দিয়ে বৃক্ষরোপণ করে যাচ্ছি। এলাকায় একটা কবরস্থান ভাড়া নিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নের মাধ্যমে সেখানে চারা উৎপাদন করি। এরপর সেগুলো বিভিন্ন জায়গায় রোপণ করি।“
আনোয়ার হোসেন আরও বলেন, “শহরের দীর্ঘ ৮ কিলোমিটার সড়কে বিভিন্ন ধরনের প্রায় ৫০০ গাছের চারা রোপণ করেছি। ইতোমধ্যে সেগুলোতে ফল ধরতে শুরু করেছে। এ ছাড়া হলোখানা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কুড়িগ্রাম পৌরসভা পর্যন্ত প্রায় ৬ কিলোমিটার রাস্তাজুড়ে ফল ও ফুলের গাছ রোপন করেছি। সবচেয়ে সৌন্দর্যবর্ধনে কুড়িগ্রাম বাস টার্মিনাল থেকে সার্কিট হাউস রাস্তাতে সোনালু গাছ লাগিয়েছি, সেগুলোতে ফুল ধরছে। অন্য দিকে কুড়িগ্রাম পৌর শহরের রোড ডিভাইডারগুলোতে বর্জ্য অপসারণ করে ফুল ও ফুলের গাছ লাগিয়েছি।”
কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ও উদ্ভিদবীদ মো. মির্জা নাসির উদ্দিন বলেন, “আনোয়ার হোসেন আমাদের সবার কাছে একটি প্রেরণার উৎস। গাছ লাগানোর ফলে কুড়িগ্রাম শহরে একদিকে যেমন শোভাবর্ধণ হচ্ছে, অন্যদিকে পরিবেশ আরও উন্নত হচ্ছে। একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিম্ন পদে চাকরি করা এই যুবকের প্রকৃতির প্রতি অসীম ভালোবাসা অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।”
জেলার পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. রেজাউল করিম বলেন, “ব্যক্তিগত উদ্যোগে ৭ হাজারের অধিক গাছ রোপণ করা সত্যি প্রশংসনীয় কাজ। আমাদের তরফ থেকে তাকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করব।”