শেরপুরের সীমান্ত ঘেঁষা নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতী উপজেলার পাহাড়ি জনপদে ঢলের পানিতে সৃষ্ট বন্যায় দরিদ্র গারো সম্প্রদায়ের মানুষের মাটির তৈরি ঘরবাড়ি ব্যাপক পরিমাণে বিধ্বস্ত হয়েছে। বাসস্থান না থাকায় এখন তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
দিন এনে দিন খাওয়া এসব আদিবাসী গারো সম্প্রদায়ের হতদরিদ্র। তারা পেটের ক্ষুধার চেয়ে মাথা গোজার ঠাঁই নিয়ে বেশি চিন্তিত। বিশেষ করে ঝিনাইগাতী উপজেলার মরিয়মনগর আদিবাসী গ্রামের প্রায় শতাধিক গারো সম্প্রদায়ের মাটির তৈরি কাঁচা ঘর ভেঙে পড়েছে। এখন তাদের খোলা আকাশের নিচে ঠাঁই নেওয়া ছাড়া কোনো পথ নেই।
জানা গেছে, অতি বৃষ্টিপাতের কারণে গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি ভোগাই, চেল্লাখালি ও মহারশি নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যা কবলিত হয়ে পড়ে। এ সময় গারো সম্প্রদায় অধ্যুষিত গ্রামগুলোর ওপর দিয়ে ঢলের পানি নেমে যাওয়ার সময় তাদের কাঁচা ঘরবাড়ি মাটির সঙ্গে মিশে যায়। রোববার (৬ অক্টোবর) থেকে উজানের পানি নামতে শুরু করায় সেসব ধ্বংসস্তূপের চিত্র এখন ভেসে উঠছে।
স্থানীয় সোমেন মারাক বলেন, “উপজেলার মরিয়মনগর, দুধনই, ভাটপাড়া, বারোয়ামারী, ধানশাইল, বাঁকাকুড়া, গজারীকুড়া গ্রামের গারো জনগোষ্ঠীর মাটির ঘরগুলো ক্ষতির শিকার হয়েছে সবচেয়ে বেশি।”
বাঁকাকুড়া গ্রামের লরেন ন্যাংজিমা বলেন, “গ্রামগুলোর মধ্যে বেশি ক্ষয়ক্ষতির শিকার ভাটপাড়া। গ্রামটির ৩৭টি পরিবারের সবগুলো ঘর নুইয়ে পড়েছে। একেকটি পরিবারে ঘরের সংখ্যা ২-৩টি। হঠাৎ করে মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে অনেক মানুষ চরম বিপদে পড়েছেন। পার্শ্ববর্তী দুধনই, মরিয়মনগর, গজারীকুড়া, বারোমারীতেও একই চিত্র।”
লরেন ন্যাংজিমা আরও বলেন, “বারোমারীর যুথিকা রাকসাম, আধুনিকা ম্রং, বণিকা চিরান, লুটিস চিরান, কবিতা ম্রং, সলিন ম্রং, মহিমা চিরান, নির্দেশ চিরান, আলফন্স চিরানসহ আরও অনেকের বাড়ি বন্যার পানিতে মাটির ঘরগুলো একেবারে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া কারও ঘর ভেঙেছে আংশিকভাবে।”
মহিমা চিরান বলেন, “ধানশাইল, বাঁকাকুড়ার প্রায় ১০টি গারো পরিবারের ঘর ধসে পড়েছে। ওই ঘরগুলো ধসে পড়ার আগেই মানুষজন ঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। এ কারণে হতাহতের ঘটনা কম ঘটেছে।”
ভাটপাড়ার বাসিন্দা সৌহার্দ্য চিরান বলেন, “উজানের ঢলে মাত্র দুই ঘণ্টার ব্যবধানে ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। আমার গ্রামের শুধুমাত্র কয়েকটি পাকা ঘর বন্যার কবল থেকে রক্ষা পেয়েছে। ঘর হারিয়ে অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন আশপাশের আত্মীয়স্বজন, পরিচিতজনদের বাড়িতে।”
একই গ্রামের ফুলমনি ম্রং বলেন, “ঘরবাড়ি সব ভাইঙ্গা নিয়ে গেছে। খাওয়ার সমস্যা হচ্ছে। গত দুই দিন ধরে কিছু খাইতে পারি না। আমরা এখন নিরুপায়।”
ষাটোর্ধ্ব মিটিলা চিসিম বলেন, “দুই দিন ধরে খাওয়া-দাওয়া নাই। কাপড়চোপড় নাই। সব তলায়া গ্যাছে। কেউ আমাদের খবর নেয় না।”
দুধনই গ্রামের মৃন্ময় চিরান বলেন, “গ্রামের প্রায় ৮-১০টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৃষ্টির মধ্যে রাতে অনেকেই তার বাড়িতে আশ্রয় নেন। ঘর হারানো লোকগুলো রীতিমতো নির্বাক হয়ে গেছে।”
স্থানীয় একটি কলেজের প্রভাষক মতিউর রহমান বলেন, “পাহাড়ি নদী মহারশি ও সোমেশ্বরীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় এ বন্যার সৃষ্টি হয়। জেলার ঝিনাইগাতী, নালিতাবাড়ী ও শ্রীবরদী উপজেলার কমপক্ষে ২২টি ইউনিয়নের অধিকাংশ রাস্তাঘাট, বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলের মাঠ তলিয়ে গেছে। অসংখ্য বাড়িঘর পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।”
এদিকে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি পুনঃনির্মাণ বা পুনর্বাসনের বিষয়ে জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান বলেন, “বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ির তালিকা তৈরির কাজ চলছে। পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেওয়া হবে।”