• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ২৮ মাঘ ১৪৩০, ১২ শা'বান ১৪৪৬

কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ‘বলিহার রাজবাড়ি’


নওগাঁ প্রতিনিধি
প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৪, ২০২৩, ১০:২১ এএম
কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ‘বলিহার রাজবাড়ি’

ঐতিহ্যে ঘেরা উত্তরবঙ্গের ভারত সীমান্তঘেঁষা বরেন্দ্র অঞ্চল নামে অবহিত নওগাঁ জেলা। এই জেলায় রয়েছে বিশ্ব ঐতিহ্য পাহাড়াপুর বৌদ্ধবিহার (সোমপুর বিহার)। শুধু পাহাড়পুরই নয়, রয়েছে অনেক ঐতিহ্যে ভরা ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপনা। তারই একটি অংশ বলিহার রাজবাড়ি।

এই রাজবাড়িতে এখন আর সেই রাজার রাজ্য নেই। কিন্তু এখনো কথা বলে এই রাজ্যের রাজা ও জমিদারের সময়কার রোপণ করা অনেক বটবৃক্ষ আর তৈরি করা নানা স্থাপনা। শুধু কালের সাক্ষী হয়ে রাজার শাসন আমলের স্মৃতি মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহ্যবাহী বলিহার রাজবাড়িটি।

এখনো রাজবাড়িতে আছে দেবালয়, সেখানে হয় না আর নিয়মিত পূজা-অর্চনা। দেবালয়ে দেবতার সন্তুষ্টিতে দেবদাসদের নৃত্যাঞ্জলি, শংখ ধ্বনি, পুরোহিতের মন্ত্রপাঠ, ধূপের ধোঁয়া আর খোল-করতালের শব্দ থেমে গেছে বহু আগে। দেবালয়ের দুর্ভেদ্য প্রকোষ্ট আর দেয়াল পেরিয়ে দেবদাসিদের হাসি-কান্নার শব্দ হয়তো এখনো ভেসে বেড়ায় বলিহারের ভগ্ন রাজপ্রাসাদের আকাশে আর বাতাসে বাতাসে।

আজ আমরা এই রাজবাড়ি সম্পর্কে জানব।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের এক সনদ বলে নওগাঁর বলিহারের এক জমিদার জায়গীর লাভ করেন। জমিদারগনের মধ্যে জমিদার রাজেন্দ্রনাথ ১৮২৩ সালে বলিহারে একটি রাজ-রাজেশ্বরী দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।

তিনি মন্দিরে রাজেশ্বরী দেবীর অপরূপা পিতলের মূর্তি স্থাপন করেন। বলিহারের ৯ চাকার রথ এতদঅঞ্চলে প্রসিদ্ধ ছিল। প্রাসাদের কিছুটা দূরেই ছিল বিশাল বাগান। বাগানে এখনো কিছু রাজার শাসন আমলে রোপণ করা গাছ রয়েছে। তবে বাগানবাড়িটির সামনের পুকুর ঘাটের একটি ছাদ এখনো দঁড়িয়ে আছে। এখানে বসত নিয়মিত জলসা। কলকাতা থেকে আনা হতো নামকরা নর্তকীর দল। বলিহারের রাজাদের মধ্যে অনেকেই উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন। রাজা কৃষ্ণেন্দ্র নাথ রায় বাহাদুর একজন লেখক ছিলেন। তার লেখা গ্রন্থগুলোর মধ্যে কৃষ্ণেন্দ্র গ্রন্থাবলি প্রথম ও  দ্বিতীয় খণ্ড অন্যতম।

দেশ বিভাগের সময় এবং জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে অন্যসব রাজার মতো বলিহারের রাজার উত্তরাধিকারী বিমেলেন্দু রায় চলে যান ভারতে। এরপর প্রাসাদ ভবনটি রাজপরিবারের অন্যান্য কর্মচারীরা দেখভাল করতে থাকেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় এবং পরবর্তী সময়ে লুট হয়ে যায় রাজবাড়ির বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী মহামূল্যবান নিদর্শন, আসবাব, জানালা-দরজাসহ বিভিন্ন সামগ্রী। দর্শনীয় প্রাসাদটির কয়েকটি ভবন বর্তমানে কোনোরকমে আজও মাথা উচ্চ করে দাঁড়িয়ে একসময়ের বলিহার রাজাদের ঐতিহ্যের জানান দিচ্ছে।

কথিত আছে বলিহারের জমিদারিতে ৩৩০টি দিঘি ও পুকুর ছিল। এখনো অনেক দিঘি ও পুকুর রয়েছে। এসব দিঘি ও পুকুরগুলোর নাম খুবই শ্রুতিমধুর যেমন; মালাহার, সীতাহার, বলিহার, অন্তাহারসহ আরও কিছু।

শৌখিন রাজাদের ছিল মিনি চিড়িয়াখানা। সেখানে ছিল বাঘ, ভাল্লুক, বানর, হরিণসহ নানান প্রজাতির পশু এবং বিভিন্ন প্রজাতির পাখি।

জনশ্রুতি আছে মোগল সম্রাট আকবরের সেনাপতি রাজা মানসিং বার ভুঁইয়াদের দমন করতে এ দেশে আসেন। তিনি তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে একপর্যায়ে বলিহার পৌঁছান। দীর্ঘপথ অতিক্রম করায় সৈন্যরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। বিশ্রামের জন্য ও মানসিংয়ের প্রেরিত গুপ্তচরের মাধ্যমে বার ভূঁইয়াদের খবর জানার জন্য যাত্রাবিরতি করেন সেনাপতি মানসিং। ওই সময় চলছিল বরেন্দ্র অঞ্চলে শুস্ক মৌসুম। বেশি দিন বসে থাকলে সৈন্যরা অলস হয়ে যেতে পারে ভেবে মানসিং সৈন্যবাহিনী দিয়ে ওই ৩৩০টি দিঘি ও পুকুর খনন করেন, যা এখনো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে গোটা বলিহার এলাকাজুড়ে।

নওগাঁ সদর উপজেলার বলিহার ইউনিয়নে ঐতিহাসিক বলিহার রাজবাড়িটি অবস্থিত। রাজবাড়ির একটি ভবন স্থানীয় একটি স্কুলের পাঠদান কক্ষ হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। নতুন স্কুল ভবন নির্মিত হওয়ায় সেখানে স্কুল পার হয়ে যাওয়ায় রাজবাড়ির ভবনটি বর্তমানে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। রাজভবনটি তৃতীয় তলা। ভবনের ছাদ থেকে বহুদূর পর্যন্ত দৃষ্টি মেলানো যায়। প্রাসাদ কমপ্লেক্সের মধ্যে অবস্থিত বিশাল দেবালয়টি স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন পূজা-অর্চনা করেন। দেবালয়ে ভেতরে অনেকগুলো কক্ষ আছে। ভবনটি একসময় দোতলা ছিল।

ভবনের ওপরে উঠবার জন্য দুটি সিঁড়ি আছে। প্রাসাদের সিংহ দুয়ার এখনো অনেকটাই শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রাসাদের পেছনের মালিপাড়ায় বিশাল আকারের পাশাপাশি দুটি শিবলিঙ্গ আছে। সেখানে পূজা হয়। প্রাসাদের ভবনগুলো ছিল একটির থেকে অন্যটি কিছুটা দূরে। প্রাসাদ চত্বরের মাঝে ছিল আটচাল। বিভিন্ন পার্বণের দিনে অনুষ্ঠিত হতো নাটক, যাত্রা, কবিগান, কীর্তনসহ আরও অনেক কিছু। আটচালার নিকটতম ভবনের সিঁড়িগুলো ব্যবহৃত হতো গ্যালারি হিসাবে। মূল প্রাসাদের সামনে সতেজ দুটি গাছ আছে। নাম নাগলিঙ্গম। বর্ষা মৌসুমে গাছটিতে ফুল আসে।

অনেক আগে নওগাঁ মহাদেবপুর সড়কে বলিহার মোড় থেকে একটি পাকা সড়ক দিয়েই চলাচল করা হতো। সড়কটির দু-ধারে ছিল বিশাল বিশাল আমগাছ। প্রতিটি গাছের আমই ছিল অত্যন্ত সুস্বাদু। এখনো অনেক আমগাছ আছে। বলিহারে শৌখিন জমিদারেরা সড়কটি নির্মাণ করেছিলেন। তখন ওই সড়ক দিয়েই রাজশাহীর সঙ্গে নওগাঁ যোগাযোগ করার ব্যবস্থা ছিল।

১৯৮০ সাল পর্যন্ত ওই সড়কই নওগাঁ-রাজশাহীর একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল। পরবর্তিতে নওগাঁ-রাজশাহী অভ্যন্তরীণ মহাসড়ক নির্মাণ করা হলে বলিহার সড়কটি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যায়। তবে এখনো সড়কটির কিছু কিছু স্থান অবশিষ্ট আছে।

এলাকার দুর্বৃত্ত আর দখলদারদের অবৈধ দখল আর অত্যাচারে রাজবাড়িটি তার অনেক কিছু নিজস্ব ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছে। এখনো যদি এই রাজবাড়িটির অবশিষ্ট অংশটুকু সরকারিভাবে প্রদক্ষেপ নিয়ে সংস্কার আর সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। তবে ভবিষ্যতে এই রাজবাড়িটি একটি ঐতিহ্যবাহী পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে।

আর যদি এই রাজবাড়িটিকে যথোপযুক্তভাবে সংস্কার করে পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করা হয়। তাহলে সরকার এখান থেকে প্রতিবছর রাজস্ব হিসাবে অনেক অর্থ আয় করতে পারবে।

সরকারের কাছে এলাকাবাসীর দাবি, যেন অচিরেই এই রাজবাড়িটির যেটুকু অংশ অবশিষ্ট আছে, তা অবৈধ দখলমুক্ত করে রাজবাড়িটির সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি করে আধুনিক মানের এক দর্শনীয় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করার।

স্বদেশ বিভাগের আরো খবর

Link copied!